সৌরভ ভট্টাচার্য
18 January 2019
টোটোনিয়া'র সমুদ্র দেখতে ভালো লাগে। সমুদ্রের ফেনাগুলোকে নাম ধরে ডাকতে ভালো লাগে। টোটোনিয়া আকাশে উড়ে উড়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবে, আসলে সমুদ্রের কোনো তল নেই। কারণ টোটোনিয়া সমুদ্রে ডুবতে পারে না। টোটোনিয়া'র জলে ভিজলে শরীর খারাপ হয়। জ্বর হয়, সর্দি হয়, হাঁচি হয়।
আজ অনেক সকালেই টোটোনিয়া সমুদ্র দেখতে উড়তে শুরু করেছে। তার হাতটা ডানার মত দু'পাশে মেলা। আসলে সে হাত দিয়ে দিক বদলায়, ভাসে তো নিজের ওজনটাকে তুলোর মত শূন্য করে দিয়ে। বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দেয় আর হুস করে আকাশে উড়ে যায়।
আজকে টোটোনিয়া পরেছে একটা গোলাপী রঙের ফ্রক, গলায় মুক্তোর মালা, মাথায় ঝিনুকের ক্লিপ। তার এগারো বছর বয়েস। তার একটা ভাই আছে, পিটুনিয়া, সে উড়তে পারে না। অবশ্য টোটোনিয়ার ওড়ার কথাটা তার মা আর সে ছাড়া কেউ জানে না। বাবা মাছ শোকানোর অফিসে কাজ করে। খুব রাগী। মা'কে মারে, ভাইকে মারে, তাকে ততটা মারে না অবশ্য। টোটোনিয়া মাঝে মাঝে তার বাবার অফিসের উপর দিয়েও উড়ে যায়। বাবা দেখতে পায় না। তাকে এই সময়টায় কেউ দেখতে পায় না, একমাত্র পাখিগুলো আর তাদের কুকুর পমি ছাড়া।
টোটোনিয়া উড়তে উড়তে আজ সেই দ্বীপটায় আবার এসেছে। একটা ছোট্টো দ্বীপ। প্রচুর গাছ। একটা ছোট্টো পাহাড়। এই নিয়েই দ্বীপটা। লোকে আসে না কেন কে জানে এই দ্বীপটায়। তবে আজ এই দ্বীপটা যেন অন্যরকম। সবুজ রঙগুলো খুব গাঢ়। আজ যেন সারা দ্বীপজুড়ে প্রজাপতিদের পিকনিক। এত রঙের প্রজাপতি! তার হাতে বসছে, ফ্রকে বসছে, মাথার ক্লিপে বসছে। টোটোনিয়া ফ্রকটা ছড়িয়ে মাঠের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। কয়েকটা ফ্লেমিংগো পাখি তার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল... “টো...টো...নি...য়া...” শেষ আকারটা যেন তাদের সুরের সাথে মিলিয়ে সারা আকাশে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। সাদা সাদা মেঘগুলোর গায়ে তার নামটা লেগে ছোটো ছোটো বরফের টুকরোর মত মাটিতে তার পাশে ঝরে পড়তে লাগল। গোলাপী ফ্রকটাকে হঠাৎ দেখে মনে হল যেন সাদা। টোটোনিয়া উপুড় হয়ে শুলো। হাতটার উপর মাথা রেখে তার বাবার কথা মনে করতে লাগল। পিটুনিয়া'র কথা মনে হল। পমি'র কথা মনে হল। সে যদি বাড়ি না ফেরে ওরা কেউ তাকে দেখতে আসতে পারবে না। কারণ ওরা কেউ উড়তে পারে না।
হঠাৎ মাটিটা কেঁপে উঠল। টোটোনিয়া জানে এটা ভূমিকম্প। এত জোর কেঁপে উঠল যে লিলিফুলগুলো রাগী হাতির শুঁড়ের মত মাটিতে দাপাতে লাগল। তার গায়ের থেকে সব সাদা মেঘের টুকরো ঝরে গেল। সে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে একটা বড় ঢেউ দ্বীপের দিকে এগিয়ে আসছে। এক্ষুণি তার উড়ে যাওয়া উচিৎ, কিন্তু যেই সে উড়তে যাবে দেখে একটা বাচ্চা ফ্লেমিংগো একটা বিশাল ফুলের মধুতে আটকে। তাকে না বাঁচালে সে ডুবেই মরে যাবে। টোটোনিয়া দৌড়ে তার কাছে গেল। তার পা-টা এতটা ডুবে গেছে যে সে সময় মত না এলে এখনি পাখির বাচ্চাটা এই মধুতে ডুবে যেত পুরো। কিন্তু ছাড়াতে ছাড়াতেই তাদের উপর দিয়ে হুস্.... করে সেই বড় ঢেউটা আছড়ে পড়ল। এক ঝটকায় টোটোনিয়া ততক্ষণে পাখিটাকে বুকের মধ্যে সাঁটিয়ে ধরে নিয়েছে। কিন্তু এত দাপাদাপিতে টোটোনিয়ার বুকের ব্যথাটা বেড়ে গেল। এবার তার সর্দি হবে, জ্বর হবে, হাঁচি হবে। ওই যে জল লাগল না?
জলটা সরে যেতেই টোটোনিয়া দেখল তাকে ঘিরে দঁড়িয়ে রয়েছে এত্ত বড় বড় ফ্লেমিংগো। একটা পাখি এগিয়ে এসে তার দিকে ডানা বাড়ালো। টোটোনিয়া পাখিটাকে তার বুকে দিয়ে দিল। এবার তাকে বাড়ি যেতে হবে। সে যেই উড়তে যাবে তক্ষুণি একটা ফ্লেমিংগো এসে বলল, যেও না টোটোনিয়া, তোমার মা ওই দিকের একটা দ্বীপে তোমার জন্য একটা বাড়ি তৈরি করেছে, সেখানে তোমায় নিয়ে যেতে বলেছে, তোমরা এখন ক'দিন ওই বাড়িতেই থাকবে।
টোটোনিয়া ভুরু কুঁচকে তাকালো।
একজন ফ্লেমিংগো বলল, বিশ্বাস হচ্ছে না তো? আমার ডানার গন্ধটা শোঁকো, ঠিক তোমার মায়ের গায়ের মত না?
সত্যিই তাই। টোটোনিয়া তাদের সাথে উড়ে গেল। উড়তে উড়তে সে আবার বাবার কথা, ভাইয়ের কথা, কুকুরটার কথা ভাবল। তারপর ভাবল, ঠিক আছে, আগে মায়ের কাছে যাক, ফিরে এসে ওদের একবার দেখে যাবে।
ওদিকে টোটোনিয়ার বাড়িতে নতুন কাঠের বানানো কফিন আনা হয়েছে। পাড়ার লোকেরা সব ভিড় করে আছে। সবাই বলছে, মায়ের কাছেই চলে গেল টোটোনিয়া।