আমি তোমার নাম দিলাম 'অসুবিধা'। আমার কলেজের দিন শেষ। আমি চিনছি জীবন। তুমি তখন সেকেন্ড ইয়ার। আমাদের এক কমোন বন্ধু নিয়ে এলো তোমায় একদিন। জৈব রসায়নের একটা জটিল বিষয়ে তুমি আটকে। আমিই নাকি পারব তোমায় দিতে সমাধান। দিলামও। তুমি তাকিয়ে থাকলে। আমার প্রথম অনুভব হল আমার অসুবিধা হচ্ছে। তুমি তাকালে আমার অসুবিধা হচ্ছে। এ অসুবিধা সুবিধার চেয়ে সহজ, কিন্তু সুবিধার চেয়ে তীক্ষ্ণ।
এরপর অবধারিত ভাবেই আবার যোগাযোগ হল। বুঝতে দেরি হল না তুমি আমার অসুবিধার কথা বুঝে গেছ। তোমার ফোন নাম্বারে সেদিন সেট করলাম একটা আলাদা রিংটোন, সবার থেকে আলাদা, পিয়ানোয় বাজানো - তবু মনে রেখো। তখন ফিচার ফোনের দিন। নোকিয়ার স্ক্রিনে তোমার নাম, আর হালকা পিয়ানোয় বাজা, তবু মনে রেখো। আমি অসুবিধায় পড়তাম। যেখানে সেখানে, যখন তখন আমার অসুবিধা তুমি তখন। তোমার চোখ, তোমার মাথা থেকে নামা, ঘাড় ছুঁয়ে থাকা কালো চুলের ঘোর, তোমার গলার আওয়াজ, তোমার হাতের আঙুলের নড়াচড়া - সব পৃথক অস্তিত্ব যেন। সবাই আলাদা আলাদা করে আমায় ঘিরছে। তোমার অস্তিত্ব যেন লক্ষ লক্ষ টুকরোতে ভেঙে আমায় ঘিরে ধরছে। আমি পালাতে হবে জেনেও পালাতে চাইছি না। আমি নিজেকে নিজের অসুবিধায় ডুবিয়ে যাচ্ছি। কোনো পরিণাম নেই জেনেও।
একদিন তুমি বললে, আমায় পেতে গেলে তোমায় বড় চাকরি করতে হবে, মিনিমাম ডব্লুবিসিএস। আইএএস হতে পারলে তো কথাই নেই।
আমি জানতাম তুমি বলবে এ কথা একদিন। কি করে? এ কথা কেউ বলতে পারে না। সবাই জানে যুক্তির চেয়ে অনুভব জানে আগে। কি করে জানে কেউ জানে না। জানতাম বলেই আমার অসুবিধা বেলাগাম হতে দিইনি কখনও। আমি জানতাম আমার অসুবিধার কথা তুমি জানো। তুমি জানো আমার জীবন চলার নিজের মত করে গড়া একটা ছন্দ আছে। তোমার ঈর্ষা হত। তুমি চাইতে আমার ছন্দ থেকে আমায় বিচ্যুত করে তুমি জিতে যাবে। আমার অসুবিধাকে আমার দুর্বলতায় এনে তুমি বলবে, এসো, পরাজয় স্বীকার করো।
আমি করিনি। আমি জানতাম তোমার সব কিছুর মধ্যে এক গভীর মিথ্যাকে তুমি লালন করো। মিথ্যাকে বশ করা যায় সহজে। সত্য বড় বেয়াদব। অবাধ্য। আমি মিথ্যা বলব না, আমি তোমার কেন্দ্রে থাকা মিথ্যার দিকে চোখ রেখে কেঁদেছি। ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে বলেছি, আমি তোমায় ভালোবাসি, এ সত্যি। আমি তোমার জীবনে প্রায়োরিটি না হয়েও তোমার ভালোবাসার কয়েক পশলা আশ্রয় চেয়েছি। এ সব সত্যি। তোমার কেন্দ্রে জমানো মিথ্যার দিকে তাকিয়েই এ সব সত্যিকে আমি লালন করেছি। ওরা একদিন ব্যর্থ হবে জেনেও।
ওরা ব্যর্থ হয়নি। আজ এতদিন পরেও আমি যখন সেদিনের কথা ভাবি, তুমি যেদিন আমার অসুবিধা হয়েছিলে। যে অসুবিধাকে পুঁজি করে বিন্দু বিন্দু সত্যিকারের ব্যথার মত ভালোবাসা জন্মেছিল আমার বুকে - সে সব দিনের কথা ভাবি। তুমি মিথ্যা ছিলে। কিন্তু তোমায় ঘিরে তোমায় নিয়ে গড়া আমার সব কিছু ছিল সত্যি। আজও তাই।
আজ তুমি সত্য হয়েছো শুনেছি। মানুষ অবেশেষে তো সামাজিক। তুমি সমাজ চেয়েছিলে যতটা আন্তরিক, হৃদয় চাওনি অতটা সত্যি করে। আজ তোমার সমাজ আছে। তোমার আকাঙ্ক্ষিত সমাজে তুমি সত্য। সেদিন যা কিছু মিথ্যা ছিল, সে ভেসে গেছে কালের স্রোতে। শুধু আমি সে অতীত বন্দরে নামলে আজও পাই কয়েকটা অমূল্য রত্ন। আমার সত্যকারের অসুবিধায় গড়া দুর্লভ সে মুহূর্তের মাধুর্য দিয়ে গড়া - আমার ভালোবাসা। আমার একান্ত সম্পদ, আমার মহামূল্যবান মুক্ত, তোমায় ঘিরে গড়া। তুমি জানলে না, কি দিয়ে গেলে তুমি আমায়। তুমি সত্যি হলে কি পেতাম, সে ভাবনা ভেবে সময় নষ্ট করি এমন বোকামি কি করি? বরং না জেনেও যা দিয়ে গেলে, তাতে সত্যের মান দুজনকেই করল সার্থক। তুমি জানতে পারলে না, আমি জানলাম শুধু, এটুকুই যা রয়ে গেল পার্থক্য।
(এতটা বলে, আমার বন্ধু বলল, আমি কবি নই। সবটুকু বলে বোঝাতে পারব না। তোর লেখা যদি তার কাছে পৌঁছায়, সেকি চিনতে পারবে আমায়?
আমি বললাম, তুই কি চাস? চিনুক?
বন্ধু বলল, জানি না।
আমি স্বস্তি পেলাম। কারণ 'সত্যি'-র মানে অনেক সময়ই তো একটাই - জানি না।)