এক বোতল জল। একটা বিছানা। একটা চাদর বলা যায়। এক প্যাকেট বিস্কুট।
দোকান বন্ধ হল। সে বন্ধ দোকানের সামনে বিছানা পাতল। দোকানের শাটার ঘেঁষে চাদরের খাঁজে বোতল আর চটিটা রাখল, সাবধানে।
তারপর উবু হয়ে বসে, চোখটা বন্ধ করে একটা একটা বিস্কুট চিবাতে লাগল মাড়ি দিয়ে। দাঁত নেই যে আর!
তারপর রোগা শরীরটা বাঁ কাতে শুইয়ে, যে দিকে শাটার, শুয়ে পড়ল।
কলকাতার বউবাজার তখন ব্যস্ত। যদিও এক একটা দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবু ঘুমিয়ে পড়ার মত তো শান্ত নয়। ঘুমিয়ে পড়ার মত পেটও ভর্তি নয়। ঘুমিয়ে পড়ার মত বিছানাও নয়। কার সাপেক্ষে?
মানুষটা একটা অতিমারী অতিক্রম করে এলো। তার অতিমারীতে বেঁচে থাকার গল্প কে শুনবে? কেউ শুনবে না। যাদের গল্প আমরা শুনি এরা তারা নয়। পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু এখন প্রায় বিস্মৃত ইতিহাস। ভুলে যাওয়ার অনেক উপাদান আছে। ভুলিয়ে দেওয়ার অনেক সচেতন, সুকৌশল প্রয়াস আছে।
করুণা করতে চাইছি না। ডিগনিটিটা খুঁজছি। সমাজে ওর গুরুত্বটা বুঝতে চেষ্টা করছি। একটা অতিমারী সে কি করে পেরিয়ে এলো? তার আগে সে কি করত? এখন সে কি করে? ভ্যাক্সিন পেয়েছে? এই যে এত এত কর্মযজ্ঞ হয়ে গেল অতিমারী নিয়ে সে তার এক কণা কিছু পেয়েছে? না হয় ভস্মই কিছুটা?
একজন বলছিলেন, বৃদ্ধাশ্রমে তিনি রাস্তায় পড়ে থাকা, পরিবারত্যক্ত মানুষদের নিয়ে আসেন। তাদের প্রথম ক'দিন কেমন কাটে? তিনি বলছিলেন, তারা প্রথম দিন সব কিছু সন্দেহের চোখে দেখে। রুটি চারটে দিলে, দুটো বিছানার তলায় লুকিয়ে রাখে। কেন? যদি কাল না পায়? খাবে কি? তার আর বিশ্বাস হয় না কাল কেউ কিছু দেবে। নিজের শরীরে শ্রমের জোর নেই। ভাগ্যের ফেরে আপনজনের আশ্রয় নেই। তবে?
এইখানেই ডিগনিটির প্রশ্ন হয় তো। মানুষের সুখী হতে বিশ্বাস লাগে। বিশ্বাস আস্থাহীন হৃদয় সুখী হতে পারে না। ধূর্ত হতে পারে, স্মার্ট হতে পারে, পার্থিবভাবে সফল হতে পারে, কিন্তু কেন্দ্রে ধিকিধিকি অবিশ্বাস, অনাস্থার আগুন সব ক্ষইয়ে ফেলতে থাকে। বাইরের সুখের মুখোশের নীচে বিষাদের পোকায় কাটা মুখ।
এই মানুষটা তবু আগামীকালের জন্য ঘুমাচ্ছে। এক প্যাকেট বিস্কুট, এক বোতল জল আর একটা শতচ্ছিন্ন বিছানা নিয়েও আত্মহত্যার কথা ভাবছে না। কারণ কোনো দৈবক্ষমতা না। কারণ, এটা তার অভ্যাস। সে নিজেকে এভাবে নিয়ে বাঁচতে জানে। এ তার অভ্যাস। আমার যেমন চারবেলা খাওয়া অভ্যাস। আমার যেমন একটা বিশেষ সামাজিক আচার-আচরণকে ভদ্রতা বলা অভ্যাস। কিছু বিশেষ জিনিসকে জানা শিক্ষা বলে জানা আমার অভ্যাস। একটা নির্দিষ্ট মাত্রার ক্রয়ক্ষমতা থাকাটা আমার কাছে সফলতা ভাবা অভ্যাস।
ওর সে অভ্যাস নেই। তাই ওর কাছে আমার ডিগনিটির সংজ্ঞা অর্থহীন। আমরা কোনোদিন পাশাপাশি বসে কথা বলব না। সমাজ সে মর্যাদাবোধ রাখার প্রশিক্ষণ আমাদের দেয়। এক বিশেষভাবে সাজানো স্তর বিন্যাসের মধ্যে আমার সিকিউরিটি। সিকিউরিটি নিয়ে ভাবা আমার অভ্যাস। কার কত টাকায়, কোন দেশের মাটিতে এই বোধ জন্মাবে সে ভাবনার কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। কিন্তু নিজেকে ইনসিকিউরড, লুজার, ফেলিওর, ডিপ্রাইভড ভাবা আমার অভ্যাস। আমার যাবতীয় অভ্যাস আমার জন্মমরণের সুতো গাঁথে। আমাকে তৈরি করে। আমার অভ্যাস আমি। এ অভ্যাস সত্য নয়, কিন্তু এ বাস্তব। আমার কাছে ভীষণ বাস্তব। আমার অভ্যাসের সঙ্গে ওর অভ্যাসের কয়েক যোজন পার্থক্য।
শুধু একটা অতিমারী কিছুদিনের জন্য সব ওলট-পালট করে দিতে চেয়েছিল। কিছুটা পেরেওছিল। তাই আবার সেই প্রশ্ন, কাটালে কি করে তুমি এত বড়ো, এত ভয়াল অতিমারী? কি খেলে? কিসে বানালে এমন ইমিউনিটি? ঘুমাতে আটঘন্টা? সুষম খাদ্যের জোগান হত কি করে? মাস্ক ছিল? স্যানিটাইজার? কিভাবে এলে পেরিয়ে?
বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। আদিম শ্রাবণ এসেছে কলকাতায়। যাকে প্রশ্ন করছি সে গভীর ঘুমে। কালকের অপেক্ষায়। তোমার কাল মানে কি?