সৌরভ ভট্টাচার্য
26 August 2019
মানুষটাকে আমি অনেক ছোটো বয়েস থেকে চিনি। নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উদাস বসে থাকতেন, ভালো স্বাস্থ্য, যুবক একজন। চোখ জলে ভিজে যেত নাম-গানে। কথা বলতেন না কারোর সাথে। আমাদের থেকে বড় অনেক, আমার তো প্রশ্নই আসছে না কথা বলার। তবে যেটুকু কথা কানে আসত, শুনতাম সংসারে প্রবল বৈরাগ্য, সবটাই মায়ামিথ্যা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছুতেই তার আকর্ষণ নেই, এমনকি কাঁচরাপাড়ার অত বড় নাম করা ব্যবসাতেও তার কোনো আসক্তি নেই।
এরপর আমি হালিশহর চলে এলাম। কাঁচরাপাড়া পাশের শহর, যাতায়াত রইল কিন্তু আগের মত অত আর না। মাঝে ওনাকে আর দেখি না। শুনলাম সাধনা করতে বাইরে চলে গেছেন। মনে কৌতুহল মিশ্রিত শ্রদ্ধা এল। ভাবলাম, বাহ বাহ, এত বড় চালু ব্যবসা ছাড়া কি চাট্টিখানি কথা, যদিও অন্যান্য ভায়েরা ব্যবসা চালিয়ে যেতে লাগলেন।
বেশ কয়েক বছর পর দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে একবার দেখলাম। নাটমন্দিরে বসে কীর্তন শুনছেন। বড় বড় সাদা পাকা দাড়ি বুক অবধি। স্থূলকায় দেহ, সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে আছেন। বেশ ভাবালু চোখমুখ। তার কয়েকদিন পর কাঁচরাপাড়াতেও দেখলাম। খালি গা, ধুতি পরে বসে। দোকানের সামনে। কিন্তু কথা বলতে ইচ্ছা করেনি।
কাল একটা ঘটনায় চমকে উঠলাম। আমি ওনাদের দোকানে গেছি আমার বন্ধুদের সাথে, ওনার ভাই জিনিস দিচ্ছেন, উনি চুপ করে একটা টুলে বসে। হঠাৎ হইহই আওয়াজ চীৎকার রাস্তায়। কি হল..কি হল..? সবাই তাকালাম। দেখি একদল কিশোর হাতে ফুটবল উল্লাস করতে করতে বাড়ি ফিরছে। এ দৃশ্য আমার চেনা, অর্থাৎ ম্যাচে জিতেছে। আমার খুব মজা লাগল, বন্ধুকে বললাম, এই বয়েসটার মজাই আলাদা। দোকানি জিনিস দিতে দিতে হেসে বললেন, তা বটে!
হঠাৎ সেই অর্ধ-নগ্ন দাড়িওয়ালা মানুষটা ক্ষেপে গিয়ে নিজের ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, ওদের ক্লাসটা দেখেছিস! ওই ক্লাসে এর থেকে বেশি কি আশা করা যায়....
ওনার সারা চোখে ঘৃণা ঠিকরে বেরোচ্ছে। আমি রাস্তায় উল্লাসে মাতা ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই ওরা সমাজের "ছোটোজাত"।
রাগে, লজ্জায়, কানদুটো গরম হল। কিন্তু ওনার ভাইয়ের উত্তরে চুপ করে গেলাম। উনি বললেন, "ফুর্তিটারও জাত দেখবি?"
ভাই বসেই গজগজ করতে লাগল।
আমি বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবলাম এরকম কেন হয়? আমি অনেক অত্যন্ত রূঢ়ভাষী সন্ন্যাসী দেখেছি, অন্যকে 'গৃহী' ট্যাগ লাগিয়ে নিজেকে মহান সাব্যস্ত করা গেরুয়াযুক্ত, গেরুয়াহীন মানুষ দেখেছি, "তোমা হতে আমি পবিত্র" এই রোগে ভোগা মানু্ষের অভাব নেই ধর্মের জগতে। নিজের বাবা-মাকে অসুস্থ অবস্থায় রেখে অন্য জায়গায় নিজের সুবিধায় ফ্ল্যাট নিয়ে থেকে ঠাকুর-মা সারদার জন্মতিথি ঘটা করে পালন করতে দেখেছি। এরা কারা? কোন বিশ্বাসে বাঁচে? বুঝি না। তবে এইটুকু বুঝি, সাধারণ মনুষ্যত্বহীন, নানা পোশাকের গরিমায় আর উঁচু তত্ত্বের আড়ালে পার পাওয়া মানুষ হয়ত এই পোড়া দেশেই আছে এত বেশি সংখ্যায়।