এমনকি যখন তসলিমা নাসরিন তোফাজ্জলের ভাত খাওয়ার ভিডিওটা দিয়েছিলেন, মানে তাকে শেষবারের মত পেট ভরে ভাত খাওয়ানোর ভিডিওটা দিয়েছিলেন, আমি তখনও বিশ্বাস করিনি। করতে চাইনি। কয়েকজন খুব কাছের মানুষ খবরটার লিঙ্ক পাঠান। আমি পড়েছি। আমি বলেছি, খুব খারাপ খবর, কিন্তু কোথাও তাও মনে হয়েছে, বিশ্বাস করব না।
আজ খাটের উপর রাখা খবরের কাগজের পাতায় লেখা অক্ষরগুলো আমাকে ধূলিস্যাৎ করে দিল। যাকে পেট ভরে ভাত খাইয়ে মারা হল, সে "ভবঘুরে" মানুষটার জীবন এক প্যারাগ্রাফে লেখা যায়। সে তার বাবাকে হারিয়েছে। মাকে হারিয়েছে। সম্বল বলতে যে দাদা তাকেও হারিয়েছে কদিন আগে। তার যে প্রেমিকা তারও বিয়ে হয়ে গেছে কদিন আগে। তাই সে পাগল হয়েছে। মানে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। কিন্তু সে সাম্য গেলেও খিদে তো পায়ই বলো। সে তাই ভবঘুরের মত ঘুরে ঘুরে নাকি খাবার চাইত। বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে ঢুকেছিল খাবার চাইতে। তাকে চোর ভাবা হল প্রথমে। দফায় দফায় মারা হল। সে খালি বলে গেল আমি চোর নই, চোর নই, আমি শুধু খেতে চাই....। তারপর তাকে পেট ভরে খাওয়ানো হল। তারপর তাকে উলঙ্গ করে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হল। অনেকেই সে দৃশ্য দেখল। অনেকেই।
মানুষের পরিচয় মানুষ নিজে শুধু বানায় না। বানায় তার আশেপাশের মানুষ। একজন মানুষ সন্তান হয়, ভাই হয়, দাদা হয়, বাবা হয়, মা হয়….কেউ তাকে সে নামে ডাকে বলে। তাকে সে নামেই চেনে বলে। সেই সূত্রেই তার মানুষ হয়ে জন্মানোর সুখ। সাধ। আনন্দ। সার্থকতা। তার পরিচয়। যেমন চারটে দেওয়াল আর ছাদ ঘিরে এক ঘর, মন্দির, মসজিদ, গীর্জা। সেটা ভেঙে গেলে সব শূন্য। মানুষের জীবনেও তাই। তার পাশের মানুষের সঙ্গে গাঁথা পরিচয়েই তার পরিচয়। প্রতিভা মানুষ পরিচয় নয়, সেটা তার অস্তিত্বের ছটা। কারুর বেশি, কারুর কম। পরিচয়ের মাধুর্য নেই তাতে। সে পরিচয় যদি হারিয়ে যায় তার? পরিচয় ছাড়া শুধু নিজেকে নিয়ে নিজে বাঁচা যে কী কঠিন, কী অসহ্য যার উপর দিয়ে না যায় সে বুঝবে কী করে। সবাই সামলাতে পারে না। তফোজ্জল পারেনি। পাগল হয়ে গিয়েছিল।
ওকে না মারলেও ও এমনি এমনিই মরে যেত। যে সব হারায় তার নিজের উপর নিজেকে নিয়ে একটা বিতৃষ্ণা জাগে। এক বুক শূন্যতার ভার যে কী, সে কি বিজ্ঞানের মানদণ্ড বোঝে গো? অনন্ত মহাকাশও পারে না সে শূন্যতার পরিমাপ করতে। সে তো এমনিই মরে যেত। নিজের উপর বিতৃষ্ণায়। নিজের উপর আস্থাহীনতায়। জীবনের সব মূল্যবোধের, সম্পর্কের, ভালোবাসার শূন্যতায়। এমনিই মরে যেত। ওকে মারলে কেন পিটিয়ে?
যারা মেরেছ তাদের উপর আমার বিন্দুমাত্র রাগ হচ্ছে না। করুণা হচ্ছে। তফোজ্জল তো তাও ভালোবাসা হারিয়ে পাগল হয়েছে। তোমরা? কী ভয়ংকর হিংসায়, বিদ্বেষে, নিজের উপর কী চূড়ান্ত হতাশায় উন্মাদ হয়েছ। তোমাদের চারদিকে কী গাঢ় অন্ধকার! এর থেকে কোনোদিন ত্রাণ পাবে তোমরা? ঈশ্বর বলো, আল্লাহ বলো, গড বলো যে নামেই ডাকো, সে আমাদের বোধের বাইরে, কিন্তু ভালোবাসার নাগালে। তাই জীবনের ভিত্তিভূমিতে নাস্তিক আর আস্তিক দুজনেই ভালোবাসাকে স্বীকার করে নেয়। ভালোবাসা মানে তো ক্ষমা। ভালোবাসা মানে তো দোষকে তুচ্ছ করে গুণকে বড় করে দেখা। ভালোবাসা মানে তো নিজের থেকেও তোমাকে আগে রাখা। তবে?
এত ঘৃণায়, এত সঙ্কীর্ণতায়, এত হতাশায়, এত অন্ধকারে বেঁচে আছ তোমরা যে তোমাদের উপর রাগ করা খুব ছোটো কথা। তোমাদের উপর করুণা। শুধুই করুণা। আর সেই পরম সত্য যিনি তীক্ষ্মবুদ্ধির কাছে অধরা, কিন্তু সরল ভালোবাসাময় হৃদয়ের কাছে দেন ধরা, তাঁর কাছে তোমাদের সবার জন্য প্রার্থনা তোমরা মনুষ্য পদবাচ্য হও। তিনি তোমাদের মানুষ হওয়ার প্রেরণা জোগান। অসহিষ্ণুতা, হিংসা, বিদ্বেষ…এসবই অন্ধকারের ঘৃণ্য প্রবৃত্তি। তার থেকে বাঁচায় যে ধৈর্য, জ্ঞান, সহৃদয়তা তা তোমাদের মধ্যে জাগ্রত হোক।
পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে অসহায়ের উপর আঘাত জেনো মনুষ্যত্বের ভিত্তিভূমির উপর আঘাত। আজ মনুষ্যত্ব যে কলঙ্কে কলঙ্কিত হল, তা দেশকালের গণ্ডী ছাড়িয়ে গেল। এ লজ্জা আমাদের সবার লজ্জা। এর প্রায়শ্চিত্ত আমাদের সবার প্রায়শ্চিত্ত। এ বিদ্বেষের জীবাণুকে নাশ করার দায়িত্ব সবার, কারণ এ এক ভয়াল সংক্রমণ।
আমরা তোমার ক্ষমার যোগ্য নই তোফাজ্জল।