টিনের কৌটো। রান্নাঘরে রাখা। ঝুলকালি মাখা তাকে।
পাশে জানলা। দোতলার ভাড়া ঘর। দুটো। একটা শোয়ার, একটা বসার। আর এই রান্নাঘর। জানলা দিয়ে দেখা যায় আসা যাওয়ার পথ।
আসে যায় তো কত মানুষ। মনে ধরে কী সবাইকে? একজন মানুষ। রোগা। চুল কাঁচাপাকা। সিগারেট ধরিয়ে ঠোঁটে, খবরের কাগজ আর চায়ে দেয় ডুব। দূরের ছবি। তবু ওই মানুষটা যেন কাছের। কী করে হয়?
তার গোছানো সংসার। স্বামী তার চেয়ে বছর পনেরো বড়। দাম্ভিক মানুষ। প্রয়োজনের বাইরে সংসারকে করে সন্দেহ। বাড়তি রান্নার পদ, বেড়াতে যাওয়া, এমনি গল্প, ভালোবাসা - এ সংসারে অচ্ছুৎ তাই।
টিনের কৌটোর মধ্যে আছে কয়েকটা কড়কড়ে নোট। বাড়তি। লুকানো। কিছু দিয়েছে সুচাকুরে দাদা। আর সামান্য কিছু সংসারের খরচ বাঁচিয়ে যা থাকে। মানে যেটুকু জমে। মেয়ের হয়েছে বিয়ে। ছেলে বাইরে চাকরি করে। টাকা দেয় না। চিঠি দেয় না।
=========
সেদিন ফিরছে রেশন নিয়ে। এলো হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি। থমকে গিয়ে দাঁড়ালো চায়ের দোকানে, উঠল চমকে।
সে রোগা মানুষটা ডুবে কাগজে, চায়েতে। জ্বলন্ত সিগারেট প্রায় এসেছে নিভে।
দোকানে বসেই তাকালো তার রান্নাঘরের দিকে। রঙচটা দোতলা বাড়ি একটা, পাঁচুগোপাল দে স্ট্রিট, ১৮ নাম্বার বাড়ি। তার রান্নাঘরের জানলা। খোলা। ইস, বৃষ্টির ছাঁট আসবে যে! ভিজবে উনুন, শিলনোড়া, তরিতরকারি। ভাড়াবাড়ির একফালি জানলা। সেই জানলা দিয়ে রান্নার ধোঁয়া মাখা মধ্যবয়সী হৃদয়ে জন্মানো ভালোবাসা…. কী তুচ্ছ! অবান্তর!
দিদি একটু দেখি…..
তাকেই বলা। সরতে বলা। সারাটা গা সিগারেটের গন্ধ। পুরুষকুলের ঘামের গন্ধ। গন্ধেই যেন দেমাক। চলে গেল সে। বৃষ্টি ধরেনি তাও। এতই তাড়া। নাকি নিজেকে ভয়ংকর গুরুত্বপূর্ণ দেখানো সেই পুরুষদের আদিকালের রোগ!
“কে ইনি? এ পাড়ায় নতুন?”
যেন বৃষ্টিতে আটকে পড়া, কথা খুঁজে না পাওয়া তুচ্ছ একটা প্রশ্নের মত প্রশ্ন করল দোকানিকে। লজ্জা পেল। দেখতে দিল না। উদ্বিগ্ন হল। বুঝতে দিল না।
চায়ের দোকানি বলতে লাগল। অ-মনস্কতার ভানে অতি-মনস্কতায় শুনতে লাগল।
“জুটমিলে ভালো চাকরি করত….. মিল বন্ধ হল… অবস্থা ভালো না এখন….”
থাক থাক। মানুষের অসহায়তার কথা বলতে নেই এভাবে বাজারে। যতই সে বাজারে এসে বসুক। তার একমাত্র বোন। বিয়ের বছর দেড়েক পর এসেছিল মাসখানেক থাকবে বলে। থাকতে পারেনি। এক সপ্তাহ না পেরোতেই ফিরে গিয়েছিল। ওর জামাইবাবুকে একটাও প্রণাম না জানিয়ে। দুই বোন নিঃশব্দে কথা বলেছিল। “অমানুষ পশু একটা”।
বাড়ি ফিরে রান্নাঘরে এসে টিনের কৌটো খুলল। কত টাকা আছে? কী হবে গুনে? সংসারে দুটো টিনের কৌটো থাকে। একটায় থাকে স্বপ্ন লুকানো। আরেকটায় থাকে পাপ, কদর্য যা কিছু। না চাইলেও যা আছে। এতেই সংসার চলে। কখনও কখনও টিনের কৌটো খুলে দেখে নিতে হয় কেউ বাড় বেড়েছে কিনা। সংসার আড়াল-আবডাল, আলোছায়া সব সহ্য করে, কিন্ত বাড়াবাড়ি বেশিদিন সহ্য করে না।