সৌরভ ভট্টাচার্য
16 June 2018
সরস্বতী প্রাইমারি স্কুল। আমার প্রাথমিক শিক্ষানিকেতন। আমি আর দিদি এক ক্লাস উঁচু নীচুতে পড়তাম। হাওড়ার সালকিয়ায় থাকি তখন। শ্রদ্ধেয় পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের বাড়ির ঠিক সামনের গলিতে স্কুল। ভোরে উঠে জল বিস্কুট খেয়ে টিনের বাক্সে খাতা পেন বই নিয়ে হাঁটা দিতাম দিদির সাথে। আমরা যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। যদি জিজ্ঞাসা করত তোমরা কয় ভাইবোন, বলতাম চার ভাইবোন – দুই ভাই, দুই বোন। পরে জানলাম ওদের জ্যাঠতুতো বোন-দিদি বলতে হয়। সে যাক, সে ‘তুতো’ ডাক সেদিনও বলিনি, আজও বলি না। এক ছাদের তলায় থাকা ঘরগুলোকে আলাদা আলাদা বাড়ি বলে না। এটাই আমাদের শেখানো হয়েছিল।
টিফিনের সময় আমি আর দিদি আবার টিনের বাক্স দুলিয়ে দুলিয়ে এ গলি সে গলি দিয়ে বাড়ি এসে চাট্টি ফ্যানভাত খেয়ে আবার স্কুলের পথে রওনা দিতাম। একদিন শুনলাম স্কুলে নাকি পাঁউরুটি দেবে। সত্যিই তাই। ডলি দিদিমণি পড়াচ্ছেন, অমনি স্কুলের মাঠে প্যাঁকপ্যাঁক করতে করতে পাঁউরুটির গাড়ি ঢুকল। সবার চোখ মাঠের দিকে। দিদিমণি দিলেন বকা। কিন্তু বকা দিলে কি হবে, খানিক বাদেই গোনাগুনতি রুটির টুকরো এক একজনের হাতে দেওয়া শুরু হল। ক্রমে বুঝলাম পাঁউরুটির মাথাটা যে পাবে সে-ই বিজেতা সেদিনের।
প্রথমদিন পাঁউরুটি বাড়ি নিয়ে এলাম। মা বকা দিলেন। না আমার খাওয়া হল, না দিদির। কে খেল আমরা জানলাম না। আমাদের বলা হল ওগুলো খেলে শরীর খারাপ করবে। কিন্তু বললেই শুনতে হবে কেন? পরেরদিন থেকে মাঝে মাঝেই পাঁউরুটি কুকুরে খেতে লাগল, ব্যাগ থেকে পড়তে লাগল, হারিয়ে যেতে লাগল, বন্ধুরা খেয়ে নিতে লাগল – আসলে সব ক’টাই নিজের পেটে সিঁধোতে লাগল। এমনকি পেন্সিলের বিনিময়ে কোনো কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষী বন্ধু পাঁউরুটির মাথা আদায় করল তাও দেখলাম। আমি নিজে অদ্দূর যাইনি অবশ্য তবে যেদিন ভাগ্যে পাঁউরুটির মাথাটা পড়েছে সেদিন মনে হয়েছে স্কুলে যেন সারাটা দিনই থেকে যাওয়া যায়। সে যতই নোংরা পা দিয়ে ডলে ডলে পাঁউরুটি বানাক, ড্রেনের জল দিয়ে আইস্ক্রিম বানানোর মতন।
স্কুলে যাওয়ার সকালটা কিরকম একটা মায়াময় হয়ে থাকত। কত লোক, কত ব্যস্ততা। তাদের ঘিরে ডিমের কুসুমের রঙের কাটা কাটা সকালের রোদ - ছাদ, কার্ণিশ, লাইটপোস্টের মাথা ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে রাস্তায় এসে পড়ছে। সেই সকালে কত লোক বউ-বাচ্চা টাইম কলের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে - কেউ দাঁত মাজছে, কেউ জল ভরছে, কেউ কাচাকাচি করছে। তার মধ্যে কেউ রকমারি দোকান খুলছে, মুদির দোকান খুলছে, চায়ের দোকানের সামনে কতরকম মানুষের ভিড়, খবরের কাগজের ডাই নেমেছে বাজারের কোনার দিকে। তার পাশে বড় ড্রেন। কুকুরগুলো হট্টোগোল বাধাচ্ছে, মাছের বাজারের দিকে যাচ্ছে, মারামারি করছে, কাকগুলো এর বাড়ির ওর বাড়ির ছাদ থেকে ডাকাডাকি করছে। তার মধ্যে কত লোকের দৌড় - কেউ বাস ধরবে, কেউ অটো, কেউ লঞ্চ ধরবে বাঁধাঘাট থেকে। তারা কেউ সেজেগুজে অফিস যাচ্ছে, কেউ তরিতরকারি মাথায় নিয়ে হনহন করে বাজারের দিকে যাচ্ছে, কেউ মাছের হাঁড়ি নিয়ে দৌড়াচ্ছে, বাজারের ব্যাগ নিয়ে কত মানুষ ঝুঁকে ঝুঁকে এটা সেটা কিনছে, কেউ লুঙ্গি পরে, কেউ পায়জামা আর জামা, মেয়েরা শাড়ি, সালোয়ার কামিজ। ওদিকে ডাক্তারের ডিসপেন্সারি খুলেছে সেখানে নাম লেখা চলেছে, যখন স্কুল থেকে ফিরব তখন দেখব কত মানুষ লাইন দিয়ে বসে। আমার আরেক আকর্ষণ ছিল জহরদার দোকান, নানা রকমের প্লাস্টিকের খেলনা পাওয়া যেত। তার বয়েস আমার বাবার মতন প্রায়, তবু সে জহরদা, তারা সারা মুখ পাটিসাপটার গায়ের মত পক্সের দাগে ভরতি। সে আমায় একবার বলেছিল কালীপূজোয় ভালো ক্যাপ বন্দুক এনে দেবে। দেয়নি। ভুলে গিয়েছিল। আর ছিল একটা চা পাতার দোকান। কি মনোরম গন্ধ ছাড়ত ওর দোকানে। একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর কমলা রঙের লুঙ্গি পরে জর্দার গন্ধে ম ম করে বলত, জেঠুকে গিয়ে বোলো ওই পাতা চা’টা এসে গেছে।
পুলক মহাশয়ের ছিল জমিদার বাড়ি। আমরা শুধু পূজোর সময় ঢুকতাম। স্কুলের উল্টোদিকেই বাড়িটা বললাম না, বাড়ি তো নয়, প্রাসাদ! এক চালার দূর্গা ঠাকুর হত। ঘরোয়া পূজো। সবার প্রবেশাধিকার ছিল। এমনকি আমাদের স্কুলের সামনে যে খোঁড়া ভিখারিটা বসে থাকত দিনের বেলায়, সন্ধ্যেবেলা নদার মুদির দোকানের সামনে, তাকেও দেখেছি ওই বাড়িতে চেটেপুটে প্রসাদ খেতে। কেউ মানা করছে না, কেউ বলছে না, দূরে যা। ওকে খেতে দেখে সেদিন আমার আনন্দে চোখে জল এসেছিল। কারণ তখন আমি বুঝে গেছি যে আমি আর দিদি যখন স্কুলের টিফিনে ফ্যানাভাত খেয়ে আবার স্কুলে ফিরি, তখনও ওর কিচ্ছু খাওয়া হয় না। আমি জেনে গেছি, যারা ময়লা ছেঁড়া জামা পরে, না খেয়ে অনেক বেলা অবধি থাকে তারা আসলে গরীব। সরস্বতী পূজোর দিন আমাদের না খেয়ে থাকতে হত যতক্ষণ না অঞ্জলি হয়, পেট চুঁই চুঁই করলেই আমার ওই খোঁড়া পা টেনে টেনে চলা ভিখারির মুখটা মনে পড়ত। কিন্তু কষ্টের মধ্যে একটা খুব আনন্দ ছিল যে রাতে কিছু না কিছু উপায়ে ভগবান ওকে খাওয়ার পাঠান, ঠাকুমা বলেছিল। ঈশ্বর কত নিরুপায় জানতাম না তো সেদিন। ও যেখানে সন্ধ্যেবেলা বসত তার উল্টোদিকের বাড়িতে রোজ সন্ধ্যেবেলা হত কীর্তন। আমি যেদিন যেদিন কারোর সাথে বাজারে যেতুম সেই কীর্তনের সুরে খুব একটা আনন্দ হত। আজও হয়, সুরের বিশ্বাসে, তার বেশি কিছু আর হয় কই? ঠাকুমার কথায় মনে এলো, একবার ডাক্তার ঠাকুমাকে এসে বললে যে ঠাকুমার নাকি হাই প্রেসার। কথাটা আমার কানে গেল। স্কুলে সুশীল মাষ্টারকে একবার হেডস্যারের প্রেসার মাপতে দেখেছিলাম। ব্যস সোজা ওনার কাছে গিয়ে বললাম, আপনাকে একবার আমার বাড়ি গিয়ে ঠাকুমার প্রেসারটা মেপে দিতে হবে যে। উনি হেসে বললেন, যাব, ছুটি হোক। ছুটি হতেই আমি ওনার রুমের দোরগোড়ায় আমার টিনের বাক্স হাতে হাজির। আমায় সাইকেলের সামনের রডে বসালেন। সামনের হ্যাণ্ডেলের রডের উপর আমার টিনের বাক্স ঠং ঠং করতে করতে চলল আমার সাথে। বাড়ির লোকেরা তো আমার কাণ্ড দেখে থ। কেউ হাসছে, কেউ বকার জন্য চোখ পাকাচ্ছে, কেউ লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার জোগাড়। ঠাকুমা বেশ লজ্জার সাথে আর নাতির জন্যে গর্বে আমোদিত হয়ে প্রেসার মাপালেন। মাষ্টার মশাইকে আপ্যায়নের জন্য বাড়িতে ততক্ষণে হুলুস্থুলু পড়ে গেছে। ওদিকে আমার মন সিঁড়ির ঘরে টালির তলায় কাঠবেড়ালি দুটোর জন্যে, ওদের খাওয়াতে হবে।
তো যেটা বলছিলাম। পুলকবাবুর বাড়িতে দূর্গা ঠাকুর দেখে সামনের রাস্তা দিয়ে দিদির মামাবাড়ি যেতে হত। বন্ধ স্কুলটা দেখে কেমন একটা লাগত। ডলিদিদিমণি, যতীনস্যার, সুশীল মাষ্টার, ঝর্ণাদিদিমণি – এরা কোথায়? কি করছে? আমার বন্ধু গুলে, খোকন, সৌমেন, গদা, সুব্রত তারাই বা কি করছে? বন্ধ স্কুলের বেঞ্চগুলো কোনো উত্তর দিতে পারত না। পুজোর অত আলোয় আমার সামনে আসা আবার স্কুলের দিনগুলোর কথা মনে পড়লে মনটা একই সাথে উৎফুল্ল আবার ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ত। স্কুলের সামনে তখন কেন জানি একটা কালীমূর্তি গড়া হত। অমন কালো মাটির নগ্ন জিভ বার করা মূর্তি দেখলে মনে হত, কিরে ঠাকুর বলে কি লজ্জা নেই নাকি, কিছু দিয়ে ঢাকা যায় না? কিন্তু বলব কাকে?
দিদি ফোর পাস করে হাই স্কুলে গেল। এক বছর আমি স্কুলে একা। টিনের বাক্সটা দুলিয়ে দুলিয়ে কতবার দিদি’র ক্লাসরুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে মনে পড়ত, তাই তো, ও তো রাজঘড়িয়া স্কুলে। ওখান থেকে তো টিফিনে বাড়ি আসা যায় না। একা একাই সেই অলিগলি দিয়ে বাড়ি আসতাম, ফ্যানভাত খেতাম, একাই আবার স্কুলে ফিরতাম। এই ঘটনাটা বহুদিন পরে আবার আমার মনে পড়েছিল যখন ওর বিয়েতে কনেযাত্রীর বাসে শেষের সিটে মাঝরাতে বসে বসে, যখন আমি ফিরছিলাম ওকে ওর শ্বশুরবাড়ি রেখে। সেদিনের সেই টিনের বাক্সের মতন কষ্ট বোঝার মত সাথি আর কে ছিল তখন?
দোলের দিন। ঠাকুর্দা আমাদের তার ঘরে ডাকলেন সন্ধ্যেবেলা। তারপর প্লাস্টিকে মোড়া দুটো স্কুলব্যাগ হাতে দিয়ে বললেন, এগুলো তোমাদের। আমি যে কি অভিভূত হয়ে পড়লাম। কারণ স্কুলে অনেকে তখন ব্যাগ আনতে শুরু করেছে। কিন্তু আমার তো ছিল না। ব্যাগটা নিয়ে এসে ঘরের একটা কোনায় রাখলাম যত্ন করে। কয়েকটা বই-খাতা ওর মধ্যে ভরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম, তারপর ছাদে উঠে হেঁটে এলাম। বেশ লাগলো। সারাদিন ঘুরি ফিরি আর ওই ব্যাগটার গায়ে হাত বোলাই, উফ্..., স্কুলটা কখন খুলবে?
স্কুল খুলল। নতুন ব্যাগে বই ভরে নিয়েছি। আমার চোখ পড়ল খাটের নীচে রাখা আমার টিনের ফাঁকা বাক্সটা। আমার দিকে তাকিয়ে। আমার দিদিশূন্য ক্লাসরুমটা মনে পড়ল। তবে তো ওরও কষ্ট হবে আমায় ছাড়া থাকতে। কিন্তু এরই মধ্যে অনেক সময়তেই যে চোখের জল গালে আসার আগেই মুছে নিতে হয় তাও শিখে গেছি। মাকে বললাম, আজ বরং ওই বাক্সটাই নিয়ে যাই। মা বললেন, না, ঠাকুর্দা কষ্ট পাবেন।
এবার? হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। যে বইগুলো আমার বাইরে রাখা ছিল, ওগুলো তাড়াতাড়ি টিনের বাক্সে ভরে বললাম, আমি এখনি আসছি স্কুল থেকে। তুই থাক এদের সাথে ততক্ষণ। অমনি সেই সাদা টিনের বাক্স হেসে বলল, আচ্ছা। আমি ওর পেটের এক কোনায় দেখি এক ছোটো টুকরো পাওরুটি। মুখে পুরে নতুন ব্যাগ নিয়ে স্কুলে হাঁটা দিলাম।
মাস কয়েক পরে ওটা লোহাওয়ালার কাছে ঠাকুমা বেচে দিলেন। আমার ততটা কষ্ট হয়নি, ততদিনে নতুন পিঠব্যাগের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে যে। টিনের বাক্স লোহাওয়ালার গাড়িতে মুখ ভার করে চলে গেলো, কি করে জানি আমার চোখ থেকে পট করে দু’ফোঁটা জল গালে পড়ল। কেন পড়ল, বুঝলাম না। আজও বুঝি না। চোখ আর বুকের মধ্যে একটা অগম্য সমঝোতা আছে, সেদিনের সেই বোবা টিনের বাক্স বুঝিয়ে গেল আমায়।