দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, আমিও যাব।
তখন মুষলধারে বৃষ্টি বাইরে। দুটো ছাতা বার করে বলল, যাবি মা.... কিন্তু মাকে তো দেখতে দেবে না এখন.... রাতের খাবার দিয়েই চলে আসব.... মিথ্যা ভিজবি....
মেয়ে বলল, জানি। তোমার জন্য যাব।
======
টোটো দাঁড়িয়ে চেনগেটে। মেয়েটা হাসপাতালের ভিতরে যায়নি। বাবা বেরিয়ে এসে মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিল, চা খাবি?
মেয়ে আর বাবা চা খেয়ে টোটোতে উঠেছিল।
"কাল কী খাবে? ম্যাগি আর ভাল্লাগছে না....”
হোমডেলিভারি বলেছি তো কাল থেকে.....
ও হ্যাঁ.... বলল মেয়ে।
=======
মেয়ের ঘরে গেল। আলো জ্বলছে। ঘুমায়নি।
ঘুম আসছে না... না রে?
বোসো.... কাল মায়ের জন্মদিন.... তুমি হাস্পাতালে যেও... আমি মন্দিরে যাব.....
বেশ..... ঘুমাবি না?
জানি না। তুমি যাও। না ঘুমাও, শুয়ে থাকো অন্তত।
========
সারাটা দিন অনেক ব্যস্ততায় কাটল। রাতে মেয়ে আর বাবা একসঙ্গে ফিরছে। টোটো দাঁড়িয়ে চেনগেটে। আজ বৃষ্টি নেই। চাঁদ উঠেছে। আজ অনেক ভালো আছে মেয়ের মা। ডাক্তার বলেছে বিপদের বাইরে।
মেয়ে হাতটা বাবার সামনে এনে বলল, দেখো ফোস্কা পড়ে গেছে…. এই দুদিন ঘর সামলাতেই আমি….
মেয়ে মুখটা ফিরিয়ে নিল। বাবা চুপ করে থেকে খানিকক্ষণ, বলল, তোর মা-ও শুরুর দিকে এরকম পুড়িয়ে ফেলত…. ফোস্কা পড়ত…..
=======
ডাক্তার বলেছে বেশিদিন নেই যদিও…. তবু এ যাত্রাটায় বিপদ কাটানো গেছে…..
মেয়ে আর বাবা এখন আর পরের বছরের প্ল্যান করে না। বেড়াতে যাওয়ার, পুজোয় ঘুরতে যাওয়ার, একটা ভ্যাকিউম ক্লিনার কী ওয়াশিং মেশিন কেনার…. এখন একটা সপ্তাহ বড় জোর ভাবে…. আনন্দের হাট বসিয়ে দেয় ঘরে…..
মেয়ে বলল, বাবা, তুমি এবার থেকে চুলে রঙ করো…..
মা বলল, করোই না… এতবার করে বলছে…..
বাবা বলল, বেশ… বেশ…..
মেয়ে বাবা দুজনেই খেয়াল করল, মায়ের কথা বলতে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে…. .আগে হত না….
রঙের কথাটা চাপা পড়ে গেল। তারপর আরো এমন ছোটো ছোটো অল্প মেয়াদি কথা উঠল। উঠেই ফুরিয়ে যেতে লাগল।
দুটোমাত্র ঘর। তিনজনে থাকে। বাব, মা, মেয়ে। ইদানীং আরেকজন কে এসেছে থাকতে। তিনজনেই অনুভব করে। অস্বস্তি হয়। বলতে পারে না।
======
বছর ঘুরে গেল। মেয়েটা কাজ থেকে ফেরে যখন টোটো করে, চেনগেটে দাঁড়ায়, মেয়েটা মোবাইল ঘাঁটে। বাবা মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়ে নামে। ভাড়া মেটায়। বাবা আগে আগে চলে। মেয়ে পেছনে পেছনে। বাবা দরজার তালাটায় চাবি ঘোরায় যখন বুকটা মুচড়ে যায়। এ ঘরে এমন অসময়ে তালা পড়েছে কবে?
একটা একটা আলো জ্বালে ঘরে। যত আলো জ্বালে তত শূন্যতা বাড়ে। দুজনে কথা খুঁজে বেড়ায়। পায় না। হাতড়ায়। হাত টেনে নিয়ে অন্ধকারে কে?
একদিন মেয়ে বলল, বেড়াতে যাবে? পুরী কিম্বা বৃন্দাবন?
বলেই মনে হল, ঘরটা অন্ধকার থাকবে এ কদিন? কষ্ট হবে না?
কথাটা চাপা পড়ে গেল।
======
তবু দুজনে একদিন হাওড়া স্টেশানে এসে বসল। ট্রেন দেরি আছে। বুকের ভিতরটা যতটা দুমড়ে গেছিল বাড়ির গলিটা ছাড়ার সময়, ছাদের দিকে তাকিয়ে, যেখান থেকে মা দাঁড়িয়ে হাত নাড়ত…. এখন ততটা করছে না…..
মেয়ে বলল, আমি বিশ্বাস করিনি তুমি রাজি হবে…..
বাবা বলল, রাজির কথা না রে…… তোকে একা ছাড়তে পারলাম না…..
মেয়ে তাকালো বোর্ডের দিকে। কত ট্রেন। ভারতের নানা প্রান্তে যাচ্ছে। কত ঘোষণা। কত ঠিকানা। তারপর কী হয়? সবাই যে যার মত নেমে হারিয় যায় যেন….. শেষ ঠিকানার কথা কেউ জানি না। সবাই একা একা যায়। একা করে রেখে, একা হয়ে গিয়ে।
মেয়ে বলল, কফি খাবে?
বাবা বলল, তুই খেলে….