খাতায় পেন ঘষে ঘষে যা লিখেছে, সে বইয়ের কথা। নিজের কথা লিখল কবে? আজ হঠাৎ নিজের কথা লিখতে গেলে ভয় করবে না?
পোস্ট অফিসের পাশে ফাঁকা মাঠ। বিকেলে বল খেলতে আসে বাচ্চারা। ক’দিন হল আসছে না। এই যে সামনেই যে রাস্তাটা, একটা বাচ্চা গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছে দু’দিন আগে। মাঠটা ফাঁকা। কেউ আসছে না তাই।
এই মাঠে আমি বসে থাকি। উল বুনি। ছড়া লিখি। চিঠি লিখি। পায়ের তলার ফাটা ছোটো ছোটো চামড়া কেকের টুকরোর মত তুলে তুলে দিই। আমি একা।
আজ সকালে আমি নিজেকে বকেছি। উদোম বকেছি। বকব না? হঠাৎ করে প্যানকেক বানাতে ভুলে গেলাম। তারপর দুটো ডিম ফাটিয়ে পাঁউরুটির সঙ্গে ভেজে খেয়ে এলাম।
এই তোমার বিয়ে হয়েছে?
"না"
ইচ্ছে না হলে কোরো না। এই দেখো, এই সোয়েটারটা গত বছর বুনেছিলাম। আগে বরের জন্য, ছেলেমেয়ের জন্য, নাতিনাতনির জন্য সোয়েটার বুনতাম। ভাবতাম, ওইতেই সব চাইতে সুখ। সার্থকতা। না গো, নিজের জন্য সোয়েটার বুনে আনন্দ পেলাম অনেক। আমাকে স্বার্থপর বলতে পারো। কিন্তু জানো দু ধরণের স্বার্থপর। এক, যে স্বার্থের বেলায় সত্যিই পর। আর দুই, যে স্বার্থের বেলায় পর না, তোমার দরকারে আসবে, কিন্তু তার জীবনে তোমাকে নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। তারা ঠিক স্বার্থপর না, কি বলব? আত্মকেন্দ্রিক? ঠিক তাও না। আসলে তাদের জীবনে তাদের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ আর কেউ না।
আমার স্বামী এমন লোক ছিল। আমার খেয়াল রাখতে ভুল হয়নি, কিন্তু কেমন একটা শীতলতা ছিল আমাদের মধ্যে। আমি সুখী ছিলাম। কিন্তু তৃপ্ত ছিলাম না। পূর্ণ ছিলাম না।
এখন আছি। এই যে শুরুতেই বলছিলাম না, আজীবন পরীক্ষা দিয়ে এসেছি, অন্যের কথা লিখে। এই প্রথম নিজের কথা নিজে বলা অভ্যাস করছি। মানুষ নিজের জিভটা অন্যকে ধার দেয় কেন বলো তো?
========
মৃত মানুষের সব চাইতে বড় আক্ষেপ কি জানো? আমার মনে হয় নিজের সব কথা বলতে না পারার আক্ষেপ। ভয় নেই, তোমায় আমি বোর করব না। আমি নিজের কথা নিজেকেই বলি। নিজেই শুনি। কত রকমের খেয়াল আসে জানো। আমাদের আগের বাড়ির পিছনে একটা খাল ছিল। পরিষ্কার। আমার খুব ইচ্ছে করত আমিও দুপুরে বসে বসে মাছ ধরব। যেমন অনেকেই ধরে। যদিও তারা পুরুষ। তবে এমন তো কোথাও লেখা নেই বলো যে একমাত্র পুরুষেরা ছিপ ফেললেই মাছ উঠবে। কিন্তু আমি কোনোদিন গেলাম না। যেদিন ওই বাড়ি ছাড়লাম, আমি একা একা খালের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদলাম। কি ন্যাকাই ছিলাম বলো। কিন্তু যেটা যখন করার সেটা করলাম না। আমরা আমাদের মনটাকে ধার কেন দিয়ে দিই বলো তো। আমাদের মন দিয়ে আমরা অন্যের চিন্তাটাও করে নিই, কেন?
======
তুমি উঠে যেতে পারো। আমি সূর্যাস্ত দেখব। জানো আমি আমার স্বামীর অত্যন্ত প্রিয় কুকুরটাকে বিষ খাইয়ে মেরেছিলাম। স্বামীর মারা যাওয়ার পর। আমার ওকে অসহ্য লাগত। আমার স্বামী যেমন মারা যাওয়ার আগে শেষ ছ'টা বছর আমার পিছনে পিছনে ঘুরত, কুকুরটাও ঘুরত। হ্যাঁ হ্যাঁ, কুকুরটার মতই ঘুরত ভালো খাবে বলে। বাইরের খাবার তো সহ্য হত না। কিন্তু আমার আর ভালো লাগত না। আমি আমাদের সম্পর্কে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। যেমনভাবে উর্বর মাটি ক্লান্ত হয়ে যায়। আমি পারছিলাম না। ও বাগানে জল দিতে গেলে আমি ওর পড়ার বইয়ের পাতা ছিঁড়ে দিতাম। খবরের কাগজের পাতাগুলো উলোটপালোট করে দিতাম। ও সাপ সহ্য করতে পারত না। আমি ওর কোনো প্রিয় রান্না বসিয়ে ওর সামনে সাপের ভিডিও দেখতাম আমাদের স্মার্টটিভিতে। ইউটিউবে। ও উঠে যেত না। কিছুটা লোভে, কিছুটা আহত পৌরুষে।
======
আমার ওর উপরে কি এক করুণা মাখা বিদ্বেষ ছিল। আজ আর নেই বলব না। তবে এখন সয়ে গেছে। আমাদের বাগানের কলের মুখটায় শ্যাওলা জমেছে। আমি ওই শ্যাওলাওয়ালা কলের মত ওকে মেনে নিয়েছি। কল যেমন জল দিয়েছে এতকাল। ও তেমন পার্থিব যা কিছু সবই তো দিয়েছে।
আমাকে নিয়ে আমি সুখী কিনা?
দেখো, আমি সুন্দর তো নই। কোনোকালেই ছিলাম না। আমার এখন ওসব ভাবার নেই। আমার শুধু অনেক কথা বলার আছে নিজেকে। যা এতদিন নিজেকেও বলিনি। সাহস হয়নি। চালাকি করেছি নিজের সঙ্গে। এখন আমার আর চালাকির দরকার নেই। মৃত্যু ছাড়া আমার উপর আগ্রহ আর কারোর নেই। এই যে গোটা পৃথিবী জুড়ে এত যুদ্ধ, খুনোখুনি, মারামারি। এ সবের থেকে অনেক দূরে আমি এখন। তবে কি জানো, আমার এই আটাত্তর বছর বয়সেও আবার বিয়ে করতে ইচ্ছা হয়। একজন ঠিক মানুষের সঙ্গে বাঁচতে ইচ্ছা হয়। সে আমায় কি বলে শোনার ইচ্ছা হয়। আজীবন তো নিজেকে মিথ্যাই বলে গেলাম। আর শুনে গেলাম অন্যের কথা, অন্য বিষয়ের কথা, যা ওদের বলতে দরকারি মনে হত আমাকে, আমার জন্যে না, ওদের নিজেদেরই জন্য। কার জামায় দাগ, কার পেটের সমস্যা, কার কাজের কি সমস্যা, কার ভালোবাসায় সন্দেহ, তাদের সংসারের হাজার কেচ্ছা…. আরো আরো….
আমার মনে হয়, যদি ঠিক মানুষের সঙ্গে থাকতাম, তবে সে আমায় কি বলতো? আমার মধ্যে কি এমন অনেক দিক থেকে গেল যা অধরা? এমন অনেক সুখ?
আমার কথা আসছে না আর। সন্ধ্যে হল। এবার আমি উঠব। রাত আসছে। আমার রাত হলে ভয় করে। নিজের অতীতের দিকে তাকিয়ে মনে হয় কত জন্মমৃত সন্তানের কবরস্থান আমার এই বুক। রাত মানে কেন অতীত হয়ে গেছে? আমার আবার সংসার করতে ইচ্ছা করে। আবার অপেক্ষা করতে ইচ্ছা করে। একটু বেসামাল হয়ে বাঁচতে ইচ্ছা করে। যৌবনে আমার শরীর ছিল সুয়োরানী, আর মন ছিল দুয়োরাণী। আজ আমার শরীর হয়েছে দুয়োরাণী, মন হয়েছে সুয়োরাণী। কিন্তু মৃত্যু এত অনড়, এত জেদি!