বইটা নিশ্চয়ই অনেকের পড়া। বা অনেকে নিশ্চয়ই শুনেছেন বইটার কথা। অথবা মুরাদের মুখে মুরাদের যৌনদাসী হয়ে থাকার অভিজ্ঞতার কথা। আবার অনেকে নিশ্চয়ই এড়িয়ে গেছেন, বা পড়তে পারেননি। এবং অনেকে হয় তো শোনেনওনি এই বইটার ব্যাপারে কিছু, কিম্বা মুরাদের বিষয়ে কিছু।
সেই ইতিহাস আবার বর্তমান। নিউজিল্যান্ডের কর্ণধার বললেন, যেন মেয়েদের কাজ করার আর শিক্ষার স্বাধীনতাটুকু থাকে। যুক্তরাষ্ট্র বলল, সংযত হও। মেয়েদের অবস্থা কি হবে? এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই। ইতিমধ্যে যা হওয়ার তা শুরু হয়েই গেছে।
চীন, পাকিস্তান সমর্থন জানিয়েছে। তালিবানকে সমর্থন জানানোর অর্থ মেয়েদের যে অবস্থাকে স্বীকৃতি দেওয়া, সেই অবস্থা নিয়ে চীন বা পাকিস্তানের লজ্জা নেই।
কুড়ি বছর ধরে তবে কি হচ্ছিল? মেয়েরা স্বতন্ত্র হল না। একটা দেশের আভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থা, নিরাপত্তাব্যবস্থা শক্তিশালী করা গেল না। অনন্তকাল ধরে আমেরিকার তত্ত্বাবধানে আফগানিস্তানের সুরক্ষা থেকে যাবে - এই কি আশা ছিল?
তবে নতুনটা হল কি? যা হওয়ার ছিল তাই তো হল। কিছু মানুষ প্যানিক করে কিছু দুর্ঘটনা ঘটালেন। দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু অপ্রত্যাশিত নয়। আজ থেকে কুড়ি বছর আগের ঘটনা যদি মনে থাকে তবে আমাদের এও নিশ্চয়ই মনে থাকা উচিত যে, সে সময়টাকেও আমরা কয়েকদিনের মধ্যেই স্বাভাবিক অবস্থাই ধরে নিয়েছিলাম যদি না আমেরিকায় ওই বোমাবাজিটা ঘটত।
তালিবান কথাটা উঠলেই কিছু মানুষ আমেরিকা আর রাশিয়ার কোল্ড ওয়ারের দিকে আঙুল তোলেন। কিন্তু সে তো হল বহুদিন। আজ তো আফগানিস্তান দখল করতে কেউ আসছে না। তবে? আজ যে তালিবান তৈরি হয়েছে সে রসদ তো তারা আমেরিকা বা রাশিয়া থেকে পাচ্ছে না। এটা তো দেশাত্মবোধের লড়াই না। এটা একটা ধর্মোন্মাদ বিশ্বাসের লড়াই এখন। তারা একটা বিশেষ নিয়মের সমাজে বিশ্বাস করে। সেই বিশ্বাসে মেয়েদের যেভাবে দেখা যায়, পুরুষদের যেভাবে দেখা হয় - সেই দিকটাকেই তারা বাস্তবায়িত করতে চায়। মেয়েদের শিক্ষা-কর্মের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে যৌনদাসী বানানোর শিক্ষা না দিয়েছিল আমেরিকা, না দেয় রাশিয়া। সমস্যাটা হচ্ছে সেই বিশ্বাস জন্মায় যে বিশ্বাসের বীজ থেকে।
আমি গতকাল থেকে বেশ কিছু বাংলা নিউজ চ্যানেলের পেজের কমেন্টস বক্সে দেখলাম প্রতিবেশী দেশের বহু তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের উচ্ছ্বাস। অর্থাৎ চীন বা পাকিস্তান নয় শুধু, এই ধর্মীয় বিশ্বাসাধীন সমাজ অনেকেই চান তবে। জোরটুকু করে উঠতে পারেন না।
কিন্তু এই সব নিয়ে আলোচনা করা যাবে না। আলোচনা করতে হবে রাশিয়া আর আমেরিকার শীতল যুদ্ধ নিয়ে। তবেই পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকা যাবে। কেউ প্রশ্ন করবে না, ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোর পরিবর্তন হল না কেন? কেউ প্রশ্ন করবে না, শুধুমাত্র বন্দুকের জোরেই এই বর্বর শাসনব্যবস্থা কায়েমী হতে চলেছে, না এক বৃহৎ সমাজের সমর্থনও আছে?
হিটলারের উদাহরণে আসা যাক। হিটলারের শেষের সঙ্গে সঙ্গে সেই নৃশংস যুগের অবসান ঘটে। কারণ হিটলার দিয়েই সেই ঘৃণা বর্বরতার সূত্রপাত। কিন্তু এইখানে? তালিবান, বোকোহারেম, ইসলামিক রাষ্ট্র ইত্যাদি দলের প্রেরণা কি শুধুই রাজনৈতিক? অবশ্যই নয়। তাদের যে ধর্মীয় বিশ্বাস পৃথিবীতে এমন ভয়ংকর ইসলামোফোবিয়ার সৃষ্টি করছে তার সংশোধন নিয়ে কতটা তৎপরতার সঙ্গে কাজ হচ্ছে? যখন কোনো ব্যক্তি কোনো অন্ধকার যুগের সূচনা করে, তবে সেই ব্যক্তির নাশের সঙ্গে সঙ্গেই সে অধ্যায় শেষ হয়ে যায়। কিন্তু যখন কোনো সংস্কৃতি, ধর্মবিশ্বাস একটা অন্ধকার দিকের সমর্থন জানায় তখন তার আশু সংশোধন দরকার হয়।
হিন্দুধর্ম, খ্রীষ্টধর্ম, বৌদ্ধধর্মের বহু পরিবর্তন হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় গোঁড়ামি থাকলেও তা বারবার সংশোধনের মাধ্যমে তাকে আবার চলনসই করে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। আন্দোলন হয়েছে, আলোড়ন হয়েছে। কিছু পরিবর্তন অবশ্যই হয়েছে। আজ থেকে একশো বছর আগের ধর্মীয় বিশ্বাস আর আজকের ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে অনেক ফারাকও হয়েছে। নানা অমানবিক প্রথার নাশও হয়েছে। কিন্তু এখানেই বারবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কেন?
ধর্মকে শূন্য করে দেওয়া যায় না। কিন্তু ধর্মের সংশোধন অবশ্যই দরকার। সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন। সমাজ আর ধর্মীয় বিশ্বাসের সংস্কার একসঙ্গে হয়। হয় বলেই প্রগতিশীল কথাটার গুরুত্ব হারিয়ে যায়নি। গায়ের জোর তখনই সম্ভব যখন বিবেক-বুদ্ধির জোর দুর্বল। নইলে জেনারেল ডায়ারের মত মানুষেরও তো অভাব ছিল না বৃটিশ শাসনে। তার পরেও একটা জাত নিজেকে মুক্ত করল কিভাবে? আর মুক্ত করেও প্রতিবেশী দেশগুলোর থেকে চিন্তা ভাবনায় এতটা এগিয়ে গেলই বা কি করে যারা একই সঙ্গে স্বাধীন হয়েছিল?
লক্ষ্মণের শক্তিশেল, মেঘনাদবধ কাব্য লিখে না তো সুকুমার রায়কে, না তো মধুসূদনকে দেশ ছাড়া হতে হয়েছিল। না তো প্রাণ দিতে হয়েছিল সেই ধর্ম আন্দোলনের যুগেও। না তো বই দুটো কোনোদিন নিষিদ্ধ হয়েছিল। একটা জাতির নবজাগরণের সূচনাই হয়েছিল ধর্ম আর সমাজের উন্মুক্তকরণের ভাবনায়, রামমোহনের হাত ধরে। এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। কিন্তু কার্টুনিস্টের গলা কেটে ফেলা, ব্লগ লেখকের গলা ফেটে ফেলা, বই লিখে আজীবন দেশান্তরিত হয়ে থাকার উদাহরণে আমরা কেন তালিবানির প্রচ্ছন্ন প্রকাশ দেখতে পাই না? প্রচ্ছন্ন আফগানিস্তানকে কেন দেখতে পাই না এশিয়া জুড়ে?
আসল কথা হল সংশোধন, সংস্কার। এই দুটো না হলে কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসই সুরক্ষিত নয়। তালিবানকে দেখে বিস্মিত হই না। বিস্মিত হই এত এত অসহিষ্ণুতা রাতদিন দেখে। অথচ সেগুলোকে গা সওয়া করে নিয়ে আজ হঠাৎ করে বিস্মিত হওয়ার চারদিকে ঢল দেখে। সত্যিই কি এতটা বিস্ময়ের কিছু আছে? তর্কের জন্য অনেক কিছু বলা যায়। সে শব্দের প্যাঁচ। কিন্তু বাস্তবটা কি আমরা দেখেও দেখি না? বুঝেও বুঝি না? রোগ অনেক গভীরে। যদি সেখানে আলো ফেলা না যায় তবে অকারণে হাত পা ছুঁড়ে সব গেল গেল করে লাভ নেই। ও সব উদ্বেগের বিলাসিতা। যেখানে দায় নেই, সে উদ্বেগ লোক দেখানো। ওতে কাজ কিছু হয় না।