Skip to main content
 
 
 
 
দুটো সিনেমা, এক, ‘থাপ্পড়’, মুক্তি পেল ২৮শে ফেব্রুয়ারী ২০২০; দুই, ‘ম্যারেজ স্টোরি’, নেটফ্লিক্সে এসেছিল ২৯শে অগাস্ট ২০১৯।
       বিষয়বস্তুগত মিলটা খুব সুক্ষ্ম। দুই ক্ষেত্রেই শুরু হচ্ছে একটা সুখী দাম্পত্য জীবন দিয়ে, শেষ হচ্ছে বিচ্ছেদে নয়, একটা বোঝাপড়ায়, যা পূর্ণ বিচ্ছেদ আর মিলনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে।
       ম্যারেজ স্টোরি, এক বাচ্চার মা, সুখী, দায়িত্ববান, যত্নশীল, নিখুঁত চরিত্র। তিনি কি করে কি করে যেন অনুভব করলেন তিনি যে সংসারে আছেন সেখানে তার মূল্য কতটুকু? তার পছন্দ-অপছন্দ, ভালোলাগা-মন্দলাগা, স্বপ্ন-আশা ইত্যাদি সবটাই তো চাপা পড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত একটা সংসারের নানা চাহিদা মেটাতে মেটাতে, এবং যে কাজটাও অবশেষে স্বীকৃতিহীন, সবটা যেন হওয়ারই ছিল, করারই ছিল গোছের।
       থাপ্পড়, একই গল্প। একটা চড়ে অনুভব করা যে সংসারে নিজের সমস্তটুকু দিতে দিতে নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলা। এমনকি নিজের প্রিয় রংটা পর্যন্ত মনে না পড়া। থাপ্পড়টা কোনো ইস্যু নয়, থাপ্পড়টা একটা ধাক্কা, যাকে 'ট্রিগারিং ফ্যাক্টর' বলে।
       সিনেমা দুটোর আরেকটা মিল, এক, দুই ক্ষেত্রেই দু'জন দরদী মহিলা উকিল। যাদের নিজেদের জীবনেও একজনের ক্ষেত্রে নানা সংঘাত ছিল (ম্যারেজ স্টোরি), আরেকজনের ক্ষেত্রে বর্তমান (থাপ্পড়)। দু'জন মহিলা উকিলেরই ভীষণ মানবিক মুখ। অন্যদিকে দু'জন পুরুষের হয়ে দুটো সিনেমায় দু'জন পুরুষ উকিল, যেখানে দু'জনেই অত্যন্ত পেশাদার (খারাপ অর্থে), অমানবিক।
       দুটো সিনেমাই অভিনয়ে, নিখুঁত পরিচালনায়, সম্পর্কের নানা টানাপোড়েনে গল্পটাকে অসামান্য বুননে এগিয়ে নিয়ে গেছে। থাপ্পড়ের শুরুতেই একটা হলুদ কাঠি আইসক্রিমের যোগাযোগে সবক'টা পরিবারকে একটা সূত্রে বেঁধে ফেলার চিন্তাটা মনোরম। দুই ক্ষেত্রেই দু'জন নারীচরিত্র আত্মসম্মান আর সুখ চায়, নিজেদের মত করে বাঁচতে চায়।
       তবু দেখতে দেখতে দুটো প্রশ্ন দিনের শেষে মাথায় ঘুরতেই লাগল, এক, থাপ্পড়ের সাথে ম্যারেজ স্টোরির এই মিলটা কি নিতান্তই কাকতালীয়?
       সে আলোচনা থাক। যেটা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল দুটো ঘটনার একটা আমেরিকা আর একটা ভারতের সমাজের প্রেক্ষাপটে হলেও, আদতে মূল কথাটা কিন্তু এক। একজন মানুষ চাইছে ন্যায্য অধিকার, মান্যতা। জন রলস তার বিখ্যাত কালজয়ী গ্রন্থ THE THEORY OF JUSTICE -এ justice বলতে বলছেন fairness -এর কথা। সমস্ত injustice আদতে এই unfairness. দুই মহিলা দুই গল্পে এই fairness বা ন্যায্যতা চাইছেন।
       কিন্তু পুরুষশাসিত সমাজে এই ন্যায্যতার সুক্ষ্মতা নিত্য অভ্যাসের জড়তায় বহুযুগ ধরে চাপা পড়ে। কিন্তু তা নিঃশেষ হয়ে কোনো যুগেই যায় না, যেতে পারে না। আত্মসম্মানটুকুকে হারিয়ে শুধুমাত্র সুযোগসুবিধায় বাঁচা মনুষ্যত্বকে অপমান। দুই মহিলা সেই অপমানের বিরুদ্ধে, সমাজের বিরুদ্ধে, যুগসঞ্চিত অন্ধকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। প্রত্যাশিতভাবেই ‘খুব বাড়াবাড়ি’, ‘তিলকে তাল করা’ ইত্যাদি তকমা দুই চরিত্রের গায়েই লাগানো হচ্ছে। যা রীতিগত বা প্রথাগত হিসাবে বাস্তব কিন্তু ন্যায় হিসাবে সত্য নয় এমন কিছুতে আঘাত লাগলে মানুষ ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে। কারণ ন্যায়ের দিকে লড়াইয়ে সত্যের যে শক্তিটা আছে, ধৈর্যটা আছে, কিন্তু শুধুই প্রথা-রীতির সমর্থনে কথা বলতে গেলে গায়ের জোর আর সংস্কারের দোহাই ছাড়া কিছুই ধোপে টেকে না। নিজের বিবেকের কাছে নিরুত্তর মানুষ সমাজের কাছে জিতে যেতে চায়, কারণ সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবিধা হয়ে আছে। 'নাথবতী অনাথবৎ' নাটকের সেই দুর্দান্ত কথাটা, সবাই মিলে একজোট হয়ে পিটাপিটি করতে তো কোনো যুগেই অসুবিধা হয় না, না?
       ‘ম্যারেজ স্টোরি’তে তাই একটা মোক্ষম কথা উঠে আসে, পুরুষ চরিত্রের দিকে তাকিয়ে মহিলা উকিল বলেন, অর্থাৎ আপনার দিক থেকে সমস্ত কথা দেওয়াগুলো হল ডিসকাসান, নিছক আলোচনা, আর আপনার স্ত্রী'র দিক থেকে সমস্ত দেওয়া কথাগুলো হল ডিল, একটা চুক্তি!
       এই প্রসঙ্গে আরেকটা কথা বলে শেষ করি। আরেকটা সিনেমা ক'দিন আগে দেখলাম, আয়ুষ্মান খুরানার সমকামী নিয়ে সিনেমা ‘শুভ মঙ্গল য়াদা সাবধান’। বিষয় হোমোফোবিয়া। সিনেমাটা সাবপ্লটের তোড়ে মূল প্লটটা গেছে ভেসে। সেই অর্থে সিনেমাটা সফল নয়। কিন্তু এখানেও সেই এক কথা, দু'জন মানুষ নিজেদের আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে চাইছে। আয়ুষ্মানের টুইট ফলো করে একটা বইয়ের কথা জানতে পারি, শরিফ ডি রগনেকারের লেখা, FROM STRAIGHT TO NORMAL. একজন সমকামী পুরুষের আত্মজীবনী। বইটা পড়ে ফেলি। সত্যি বলতে এমন একটা খোলামেলা, সৎ, self-pity -হীন আত্মজীবনী খুব কম পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সিনেমাটা যেকথা বলতে চেয়েও পারেনি, বইটা তা বলেছে। যদিও এর অর্থ এই নয় যে এই বইটার উপরেই গল্পটা। কিন্তু বইটা পড়তে পড়তে যেটা বারবার মনে হয়েছে সমাজের নানান রীতিতে মানুষে মানুষে এই অসাম্যের গভীরতা অনেকদূর অবধি বিস্তৃত। সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা তার চাইতে আরো বেশি এই যে সেই অসাম্যের সাথে আমাদের বোধহীন অভ্যস্ততা। হঠাৎ কেউ সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে গেলে একই সাথে অহং আর অভ্যস্ত বিশ্বাসে এমন ধাক্কা লাগে যে মনে হয়, কি দরকার ছিল এ সবের? আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকায় কোনো অসুবিধা তো হচ্ছিল না, তবে খুঁচিয়ে ঘা করার কি দরকার?
       আমরা মানতেই পারি না, খুঁচিয়ে ঘা করছি না, আমাদের অমানবিক প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় যে ঘা-গুলোকে তৈরি করছি এগুলো সেই ঘায়েরই ছবি, আমাকে সমাধানের জন্য ডাকা হচ্ছে না, আমাকে একটু সহৃদয় হয়ে তাকাতে বলা হচ্ছে।
       শেষে একটা বলেই শেষ করি, যারা স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে আছেন, কখন সে আসবে আর আপনাকে ‘থাপ্পড়’ সিনেমাটা দেখাতে নিয়ে যাবেন, কারণ নানা কারণে আপনি একা সিনেমায় যেতে পারেন না, সবটা জেনেও যেতে পারেন না, তারা যাওয়ার আগে জেনে যান থাপ্পড়টা আপনার কপালেও জুটবে। বরং আপনি আপনার ‘ভালো’ ইমেজটা নিয়ে যা করছিলেন করে যান, বেরিয়ে এসে বলবেন না, বড্ড বাড়াবাড়ি, নিজেকে সম্মান করার কথাটা ভুলে গেলেও যদি কেউ সেই সম্মানটুকুর জন্যে লড়ছে, তাকে অন্তত সম্মান করুন, অথবা দূরে থাকুন।