Skip to main content

কতটা বাস্তববাদী হব? ICU -এর বাইরে বসে বসে ভাবতাম। কতটা বাস্তববাদী হতে হবে? আমার ইচ্ছা, ভালো লাগা, ভালোবাসা, আশা, আকাঙ্ক্ষা --- সব অবাস্তব। আমার এই শরীরটা ছাড়া সব অবাস্তব। অক্সিজেন নল, স্যালাইন, মাথার পাশে রাখা আরো কি কি সব যন্ত্র, ডাক্তার, নার্স, আয়া, হাস্পাতালের বেডগুলো, স্ট্রেচার, অপারেশান থিয়েটার, সিঁড়ি, লিফট, ওষুদের দোকান, ওদিকে মর্গ --- এসবই বাস্তব। কে ছিল বা ছিলেন বা আছে বা আছেন ICU -তে? সে প্রশ্ন অবান্তর। যে আছে সে আমার স্নায়ুর সাথে জড়িয়ে। স্নায়ুর উপর বাস্তবের দৌরাত্ম্য; অবাস্তব স্বপ্নের জাল, ঝুলের মত ছিঁড়ে ছিঁড়ে দিচ্ছে। আমার কিছু বলার অধিকার নেই।


       হঠাৎ একটা বাচ্চা দৌড়ে গেল। তার মা ভীষণ অসুস্থ। তার দিদি নর্দমার ধারে বসে বমি করছে। সারারাত হাস্পাতালে জেগেছে। তার মায়ের এই সকালেই হঠাৎ হৃৎযন্ত্রে কি একটা হয়েছে, ডাক্তার-নার্স দৌড়াদৌড়ি করছে। এই সময় কি অনুভব করে মানুষ? কিচ্ছু না। অনুভবকে জানতে অবসর লাগে। আমার যেমন এখন অবসর। কিন্তু ওদের নয়। ওরা দৌড়াদৌড়ি করছে। দিশা পাচ্ছে না। এত বাস্তব জগতে হাঁটার অভ্যাস নেই তো মানুষের। দিশা পাবে কি করে?

       এই যে চায়ের দোকানে এলাম, এই চায়ের দোকানে সবাই গম্ভীরমুখে বসে। বিষণ্ণ। উদ্বিগ্ন। হতাশ। কেউ দরদাম করে না। সামনে টোটো, অটো রিকশার স্ট্যাণ্ড, একটু দূরে খাটের দোকান। যেই খাটগুলো বাস্তব। শুধু প্রাণহীন বাস্তব শরীরটাকে নিয়ে যায়। জীবন্ত মানুষের খাটে অবাস্তব অবসর, বিশ্রাম, ভালোবাসা। বাচ্চা ছেলেটা চায়ের দোকানে এল। আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে। চোখে জলের রেখা। শুকিয়ে গেছে। দাগটা ভূগোল বইয়ের নদীর মানচিত্রের মত। মানুষের সারাটা জীবনে কত নদীর মানচিত্র, কান্নার ইতিহাস। সব নদীর নাম মুখস্থ বলতে পারে না মানুষ।


       খেয়াল করলাম, বাচ্চা ছেলেটা সামনে দাঁড়িয়ে।
       মা কেমন আছেন এখন?
       গুজর গেয়ি....
       তুমি এখানে?...... জিজ্ঞাসা করলাম না। তাকিয়ে আছি তার মুখের দিকে বিশ্রীভাবে খেয়াল করিনি। সে আবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ক্লাসে বাধ্য ছেলের পড়া দেওয়ার মত বলল, পিতাজীকে লিয়ে.....


       এখন চা খাবে? হ্যাঁ চা খাবে। আমি উঠে গেলাম। পিতাজী একটা বেঞ্চে বসে। প্রকৃতিস্থ নয়। এলিয়ে শুয়ে। মাথার কাছে এক বৃদ্ধা রমণী। আঁচল চাপা মুখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বিহ্বল কৌতুহল। ছেলেটা চা এনে দিল....

       বিস্কিট?

       ছেলেটা আবার দৌড়ালো.... এগিয়ে গেলাম। মদের গন্ধ। চোখদুটো লাল। ঝাপসা চোখে আমার দিকে তাকালো। আবার চোখ বন্ধ। বৃদ্ধা মুখ লুকিয়েছে আমায় দেখে। বিস্কুট এলো। দিদি এল ছেলেটার। কয়েকটা হাড়ের উপর জামা জড়ানো শরীর। চোখ দুটো গর্তে ঢুকে। ভাইকে কাছে টেনে বলল, কুছ খায়া?

       ভাই মাথা নাড়ল। বাবার কাঁপা কাঁপা হাতে ভাঙা বিস্কুট। কাত হয়ে পড়া কাঁচের গ্লাসে চা। পড়ে যেতে পারে প্যাণ্টে। কেউ সোজা করে দিচ্ছে না। বাড়ি হলে, অন্যদিন হলে করে দিত নিশ্চয়।

       জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছিল মায়ের?

       দিদি ভাঙা বাঙলায় বলল, বুখার হয়েছিল... চারদিন.... ডাক্তার বলেছে অপেক্ষা করতে... বডি দিতে দেরি হবে.... বস্তিতে খবর দিয়েছে... লোক আসছে...

       বেডের থেকে নিয়ে যাওয়া হয়ে গেছে। সাদা কাপড়ে একটা ট্রলির উপর রাখা করিডরে, একপাশ করে, লোকের যাতায়াতের অসুবিধা না হয় যাতে। মেয়েটা মায়ের শরীর ধরে দাঁড়িয়ে। বাবা রেলে খুব সামান্য কিছু কাজ করে। কি কাজ জেনে কি হবে? মানুষ তো কাজ করতে জন্মায় না, বাঁচতে জন্মায়। বাঁচা হয়ে গেছে এই সাদা চাদর জড়ানো মানুষটার। এইরকম এক পাশে থেকেই। তাই এখনও আপত্তি জানাচ্ছে না। মেয়েটাও না। বাচ্চা ছেলেটা দিদির পাশে এলো, কানে কানে বলল, খিদে পেয়েছে। বাইরে পাঁউরুটি ঘুঘনি পাওয়া যাচ্ছে।

       আমি নিয়ে যাচ্ছি ওকে।

       আমার সামনে শীর্ণ শরীর একটা মানবশিশু। যার জন্মানোর সাথে আত্মসম্মানবোধ জম্মেছে। যার খিদেও আছে। একটা এতবড় সভ্যতা শুধু সেই খিদের ছিদ্র দিয়ে ঢুকে তার আত্মসম্মানবোধকে চুরি করে এনেছে। তারপর ভেবেছে তাকে দিয়ে সে যা খুশি করিয়ে নিতে পারে। যে অবহেলা, বঞ্চনা - এসবের মানে কোনোদিন জানবে না। নিজের অধিকার বুঝতে কয়েক প্রজন্ম লাগবে। হয় তো বুঝবে না। আত্মসম্মানের বিনিময়ে অন্য কিছু দিয়ে দেবে সমাজ। আবার ভুলে যাবে সে।

       চা খাবি, না কোল্ড্রিংক্স?

       কাজল ঘাঁটা চোখে আমার মুখের দিকে তাকালো। বড় বড় চোখ। সমাজে যাকে লোভ বলে। আমি লোভের সংজ্ঞা জানি। তাকে বললাম, বোস। অনেকদিনের তৃষ্ণা জমে যা হয় তা লোভ না, বঞ্চিত প্রাণের বিস্ময়। ঈশ্বর অন্যদিকে তাকান তখন কেউ এভাবে তাকালে। লজ্জায়।

       একটা সরু কাঠের বেঞ্চ। পা দুটো অল্প দুলিয়ে দুলিয়ে খাচ্ছে সদ্য মা-মরা, মাতাল বাবার ছেলে। অনাথ। মানুষ সুখ পেলে পা দুলায়। তার সামনে রাখা স্ট্র ঢোকানো কালো ঠাণ্ডা পানীয়ের দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে। তার পাঁউরুটি শেষ হয়নি যে এখনও। এখন চিবানোর তাড়া। তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। বাঁ-হাতে ছুঁয়ে দেখল বোতলটা কতটা ঠাণ্ডা।

       স্ট্র মুখে দিয়ে টানল। অনেকটা, যতটা একসাথে টানা যায়। আমার দিকে তাকাচ্ছে না। দূরে কয়েকটা কুকুরের বাচ্চা টোটোর চাকার পাশে শুয়ে খেলছে, তাই দেখছে।

       একটা ম্যাটাডোর এল। ভর্তি লোক। হাস্পাতালের ভিতর ঢুকে গেল। ভাষা আর পোশাকে মনে হল এসে গেছে ওদের লোকজন। কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন মহিলা দোকানের দিকে দৌড়ে এসে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে চীৎকার করে কেঁদে উঠল। ছেলেটার হাতের থেকে অসম্পূর্ণ কোল্ড্রিংক্সটা কেড়ে নিতে গেল একজন পুরুষ। ছেলেটার হাতের শক্ত মুঠোতে অপ্রস্তুত হয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালাম। ওরা ছেলেটাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। সাদা চাদরে মোড়ানো মৃত শরীর, তার মা অপেক্ষা করছে। ছেলেটা ঘুরে তাকালো, চোখের কাজল লেপ্টে গেছে গালে, ছলছল করছে। কাঠের বেঞ্চে রাখা প্রায় অর্ধেকের বেশি ভর্তি কালো শীতল পানীয়ের বোতল, সাদা স্ট্র।

       আমার দাম মেটাতে হবে। সমাজের বেড়ি উল্লঙ্ঘনীয় নয়, হৃদয় উল্লঙ্ঘনীয়। হাঁটতে হাঁটতে হাস্পাতাল ছাড়িয়ে দূরে এলাম। মানুষ মারা গেলেও তাকে ছুঁয়ে থাকতে হয়, বেঁচে থাকলেও ছুঁয়ে থাকতে হয়। মানুষকে ছুঁয়ে থাকা মানে ভালোবাসা। না ছুঁয়ে থাকা মানে অশুচি, দিশাহীন।