আগে বাড়িটা কেমন বলি, তারপর গল্পটা বলব। মাটির একটা ঘর। মাথায় টালি। সামনে অল্প একটু বাগান। বাড়ির উঠানে দাঁড়ালেই গঙ্গা দেখা যায়। বাড়ির ছাদের উপর কলাগাছের পাতার ছাওনি, তার উপরে আকাশ। আকাশে রাতে তারা। মাঝে মাঝে শাদা মেঘ। মাঝে মাঝে কালো মেঘ। আর বাকি সময় নীল আকাশ।
যার গল্প, তার নাম দিদা। তার মনে হয় তার বয়েস হল গিয়ে কয়েকশো বছর। সরকার হিসাব করে দেখেছে বিরাশি। সরকার অবশ্য তাকে দিদা বলে চেনে না, সরকারের খাতায় তার নাম রাধারাণী বেপারী। তার স্বামীর নাম নিশিকান্ত বেপারী; স্বর্গীয়। সে যেন গত জন্মের কথা, যখন তার পাছা পেতে বসলে এই মাটি শানানো মেঝেতে দুটো হাড় তীরের ফলার মত বিঁধত না। তার স্বামীর স্বর্গবাস হল তো স্বজ্ঞানেই, সে তখন তো পাছা পেতেই বসেছিল স্বামীর মাথাটা কোলে নিয়ে। গঙ্গাজল দিচ্ছিল ঝিনুকে করে করে। পাছায় লাগছিল না তো তার। গঙ্গায় এত জল কিন্তু এক ঝিনুক জল ফুরাতে না ফুরাতেই তার স্বামীর প্রাণবায়ু ফুরিয়ে গেল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল রাধারাণী, সে একা মানুষ আর কত পারে?
ডাক্তার বলেছিল, পক্ষাঘাত। একজন ভালো সুস্থ মানুষ, গঙ্গায় স্নান করে এলো, বলল খেতে দাও। রাধারাণী আগেভাগেই ভাত চড়িয়েছিল সেদিন। অনেক সকালে মাটি কাটতে গিয়েছিল, খিদে পেতেই পারে। বাড়ির পটল, লাউশাক, গঙ্গার মাছ, হাটের চাল, ডাল - কি তরিজুত করে রেঁধেছিল। কিন্তু কপাল, সে ভাত খাওয়া আর হল না। কল্যাণীর পাঁচশো বেডে নিয়ে গেল। ক'সপ্তাহ যেতে না যেতেই ডাক্তার বলল, বাড়ি নিয়ে যাও। রাধারাণী নিয়ে এল। কি মানুষ গেল আর কি মানুষ এল! কথা বলতে পারে না। উঠতে বসতে পারে না। শুধু তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আর গোঁ গোঁ আওয়াজ করে। মাঝে মাঝে কাঁদে। রাধারাণীর বিয়ের আগের, বাপের বাড়ির পোষা বেড়ালটার কথা মনে পড়ে। সে ওপার বাংলার গল্প। তার বাপের বাড়ির। তার পোষা বেড়াল ছিল। সারাদিন তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। মিউ মিউ করে যা বলত, রাধারাণী সব বুঝে যেত। এখন কেমন নিশিকান্ত'র কথাও বুঝতে পারছে রাধারাণী। রাধারাণী ভাষাকে প্রাণ দিয়ে শোনে। কান দিয়ে না। বাতাসের ভাষা বোঝে। নদীর ভাষা বোঝে। বৃষ্টির ভাষা বোঝে।
নিশাকান্তের এক-একটা গোঁ এক-এক রকম। কোনোটা খিদের। কোনোটা হিসি বা হাগুর। কোনোটা তেষ্টার। কোনোটা ওপাশ ফিরিয়ে দেওয়ার। আবার কোনোটা এমনিই, কান্নার। কান্নার গোঁ-টা বেশিদিন কান্নার থাকল না। ধীরে ধীরে হল রাগের। আবার বেড়ালটার কথা মনে পড়ে গেল। রাধারাণীর বেড়ালটা যখন চারটে বাচ্চা দিল, আর চারটেই মরে গেল, বেড়ালটাও এমন রাগী হয়ে গিয়েছিল। তাকে অনেকবার আঁচড়ে দিয়েছিল। লোকে বলত হাস্পাতালে যা, নইলে তোর পেটে বেড়ালছানা হবে। রাধারাণী একবারও যায়নি, সন্তানহারা মায়ের শোকের আঁচড়, ওতে কয়লা পোড়া তাপ আছে, বিষ নেই। তবে রাধারাণীর পেটে বেড়াল হয়নি, মেয়ে হল, ঝুমা। রায়পুরে থাকে, বেহালার ওদিকে। দুটো ছেলে ওর।
সন্ধ্যে হব হব। রাধারাণী একটা নতুন থালা আর আর গ্লাস ঝুঁকে চৌকির তলা থেকে বার করল। মেঝেতে রাখল। উবু হয়ে বসে এখন সব সময়। পেতে বসলেই খোঁচা ব্যথা। কোমর টাটিয়ে যায়। গ্লাসের গায়ে আর থালার গায়ে স্টিকার লাগানো। চোখটা কাছে এনে, কুঁচকে খুঁটে খুঁটে তুলল রাধারাণী। কাল তার জন্মদিন। মহালয়া। মহালয়ার দিন ভোরে জন্মেছিল। সবাই বলেছিল নাম রাখো দুর্গা। ঠাকুর্দা রাখেনি। তাদের বৈষ্ণব বংশ, তাই নাম হল রাধারাণী।
নিশিকান্ত চলে যাওয়ার পর থেকে প্রতি বছর জন্মদিনে রাধারাণী নিজের জন্য একটা করে স্টিলের থালা আর গ্লাস কেনে। সেই থালায় আলুসিদ্ধ, লঙ্কা আর জিরের গুঁড়ো দিয়ে মাখা, আর সাদা শিউলির মত ভাত, আর এক চামচ মত পায়েস নিয়ে সে দুপুরে খেতে বসে। নতুন শাড়ি কিনতে তার ইচ্ছা করে না। কি হবে কিনে, থাকবে এ শরীর? পুড়িয়ে দেবে। পাড়ার লোকেরাই পুড়িয়ে দেবে। মানুষ থাকে না, থালা বাসনগুলো থেকে যায়। ওপার বাংলা থেকে আসার সময় চারটে কাঁসার থালা, আর তিনটে কাঁসার গ্লাস এনেছিল। সে আর নেই। সব বিক্রি করতে হল, তার গয়নাগুলোও তো, নইলে এই জমি পেত? সরকার থেকে জমি দিচ্ছিল তখন উদ্বাস্তুদের জন্য। কেউ বলেছিল ফ্রিতে দিচ্ছে, কেউ বলেছিল অল্প দাম দিতে হচ্ছে। কি হয়েছিল রাধারানীর মনে নেই। শুধু জানে তার গয়না আর কাঁসার বাসনগুলো বেচে দিতে হয়েছিল কাঁচরাপাড়ায় গিয়ে। নিশিকান্ত বলল, খাই না খাই, আগে একটা মাথা গোঁজার জায়গা তো হোক। সেই হল। কিন্তু উদ্বাস্তু শব্দটা ভালো লাগত না, আকাশ বদলালো না, ভাষা বদলালো না, মাটির গন্ধ বদলালো না, শুধু ভিটেটাই বদলে গেল। সে তো মেয়েদের জীবনে কতবার বদলায়। বাপের ঘর থেকে স্বামীর ঘর। তার থেকে ছেলের ঘর কি আশ্রম, কি রাস্তায় - মেয়ে মানুষ মানেই তো তবে আলগা ভিটে, উদ্বাস্তু নাকি?
সামনের রাস্তাটা চারটে বাঁক পেরোলেই শ্মশান। তার পাশ দিয়েই বাজারের রাস্তা। রাধারাণী রোজ সকালে কিছু ফুল, কয়েকটা শাকসব্জী নিয়ে বাজারে বসে। আজকাল মাঝে মাঝে যায়। কি একটা রোগ চারদিকে। মুখে কাপড় বেঁধে যেতে হয়। আগে যখন মুখ নাক খুলে হাঁটত, শ্মশানের পাশ দিয়ে গেলেই নিশিকান্ত'র গায়ের গন্ধ পেত। মাটি, ঘাম আর বিড়ির গন্ধ মিশিয়ে একটা নিশ্চিন্ত করা গন্ধ। ভাবতে ভাবতে কোথায় হারিয়ে যায় রাধারাণী। ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বাজারে যায়। উবু হয়ে বসে কয়েক ঘন্টা। পা’টা টাটিয়ে আসে। একটু দাঁড়িয়ে ছাড়িয়ে নেয়। দাঁড়ায় যখন তখন নিজের ছায়া পাশের পালেদের মুদির দোকানের দেওয়ালে দেখে চমকে যায়, যেন অর্জুনের ধনুক। এমন বেঁকে গেল কি করে মনে করতে পারে না। মনে হয় এই তো সেদিন জন্মালো! আবার কখনও মনে হয় তার কয়েকশো বছর বয়েস। বাঁকা ছায়াটা দেখতে দেখতে রাধারাণী উদাস হয়। বাজারের ভিড়ের আওয়াজে দীর্ঘশ্বাস ঢেলে দেয় জলের মত। সব্জী আর মাছের গন্ধে কোথায় ভেসে যায়!
অন্ধকার হয়ে গেছে। গঙ্গার পাড়ে যারা ঘুরতে এসেছিল কেউ নেই। সোজা সরু রাস্তাটা নির্জন। রাস্তার আলোগুলো জ্বলে গেছে। এই কয়েক বছর হল তাদের এই গ্রামটায় পাকা রাস্তা, আলো এসেছে। রাধারাণী এই সময়টায় একটু হাঁটতে বেরোয়। একা একা হাঁটে। চারদিকে বাঁশের মাচা করে করে পাট শুকাচ্ছে। পাটের গন্ধ পেলে মনে হয় তার জন্মদিন এসে গেল। নাতিগুলো পাটের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। বলে, গা গুলায় দিদা। রাধারাণী ঘরে ধূপ জ্বেলে দেয়। মানুষের মধ্যেই তো ভগবান ঘুমায়, জাগে, খায়, চেতনা দেয়। রাধারাণী আর নিশিকান্ত'র একসাথে দীক্ষা হয়, হালিশহরের চৈতন্যডোবায়। সেখানে কিশোরীদাস বাবাজী ছিলেন। নিশিকান্ত বলত, সাক্ষাৎ গৌরাঙ্গের অংশ যেন। কি ভক্তি, কি জ্ঞান! যেদিন দীক্ষা হল সেইদিন গুরুদেব বললেন, শুধু গলায় তুলসীমালা নিলে আর নিরামিষ খেলে বৈষ্ণব হয় না গো। বৈষ্ণবের আচরণ শিখতে হয়। সে মানুষ কপট হয় না, আর কাউকে দুঃখ দেয় না। সেই খাঁটি বৈষ্ণব। গুরুদেব আরো বললেন, তোমরা তো পড়তে লিখতে পারো না, যেখানে পাঠ হবে শুনবে আর মাঝে মাঝে আমার কাছে উৎসব পার্বণের দিন আসবে, কথা হবে শুনবে, ভোগের প্রসাদ পাবে।
কিন্তু আর যাওয়া হয়নি। রাধারাণী শুনেছে তিনি দেহ রেখেছেন। রাধারাণী হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে ভগবানের নাম করে। ভগবান তার সাদা থানের উপর ঘাসের শীষের মত আঙুল দিয়ে সুখের বিলি কেটে যায়। কত সুখ তার এই সাদা থানে জমে, নাকি কত দুঃখ, বোঝে না রাধারাণী, সবই একরকম, জোয়ার-ভাটা। রাধারাণী হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধারে এসে দাঁড়ায়।
রাধারাণী গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে। সামনেই একটা বটগাছ, তার তলায় শিবমন্দিরে প্রদীপ জ্বেলে গেল রায়বাড়ির গিন্নী। খুব অহংকারী। ওদের মাচায় কত বড় বড় লাউ হয়, দেয় তাকে? দেয় না। না দিক। রাধারাণীর মন এখন গঙ্গার মত। মড়াও ভাসে আবার প্রতিমাও বিসর্জন হয়। রাধারাণী শুধু বেঁচে থাকে। মনে বয়ে চলে।
রাত্তিরে একটু সাগু খেয়ে শুয়ে পড়ল রাধারাণী। চাল বাড়ন্ত। কাল পায়েস হবে না। ভাত অল্প একটু হবে, তাও একবেলা। জন্মদিনের দিন মুখে একটু অন্ন দিতে হয়। রাধারাণী তাই অল্প একটু চাল বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে এসেছে এই ক'দিন, কোনো কোনো বেলা খায়ওনি। রাধারাণীর জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যায়। আর দূরে কয়েকটা বিদ্যুতের লোহার খুঁটি। গঙ্গার উপর বসানো। মহেশের নৌকা করে অনেকবার ওই খুঁটির কাছ দিয়ে ঘুরে এসেছে সে আর নিশিকান্ত। কি গানের গলা ছিল মহেশের! মহেশ তাদের কেউ হত না, আবার অনেক কিছু হত। নিশিকান্ত ডাকত ভাই বলে। রাধারাণী ডাকত নাম ধরে। একদিন ধুম করে সব ছেড়ে চলে গেল মানুষটা। কেউ কেউ বলে সে নাকি হরিদ্বারে গিয়ে সন্ন্যাসী হয়েছে, আবার কেউ কেউ বলে বাগনানে নাকি সংসার পেতেছে। এই বয়সে সংসার? তাক লেগে যায় ভাবতে রাধারাণীর। তার স্বামীর থেকে অবশ্য বছর বারো ছোটো ছিল, তাও কি সংসার পাতার বয়েস? পাতুক। মন তো নদী আর দেহ হল চর। চরই ভাঙে। নদী বয়ে চলে। যদি তার চলার সাথী কেউ আসে, আসুক।
ঘরের মধ্যে ইঁদুরের চলাফেরা শুনতে পাচ্ছে রাধারাণী। তার ঘরে বাসা বাঁধছে। তারা যখন ঘর ভেঙে এ দেশে এল নিশিকান্ত প্রথম প্রথম মুসলমান দেখলেই রেগে যেত। মুখে যা আসত বলে দিত। পরে শান্ত হল। দীক্ষার সময় গুরুদেব বললেন, ক্ষমা করতে শেখো। নিশিকান্ত তুবড়ির মত জ্বলে উঠল, ওদের, না গুরুদেব! ভিটেছাড়া করালো....
গুরুদেব শান্ত হেসে বললেন, পারবে, নামের স্রোতেই পারবে। হিংসা আর ভালোবাসা কি একসাথে থাকে ঘরে? একদিন আজানের সুরেও বাঁশি শুনবে। মানুষ আল্লাহ বা হরিকে ডাকে কেন বলো তো?
নিশিকান্তর গাল গড়িয়ে জল। ঘর হলে, তাদের বিছানা হলে রাধারাণী আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিত, চুমু খেত। কিন্তু এ যে তার ঘর নয়, গুরুগৃহ। বিছানা নয়, গুরুর আসন।
গুরু বললেন, মানুষ ডাকে ডাকার আনন্দে ডাকে, সাড়ার প্রত্যাশায় নয়। ডাকের মধ্যেই সাড়া থাকে। হিংসা ছাড়ো নিশিকান্ত। শান্ত হও। শান্ত না হলে মানুষ বেওয়ারিশ!
চোখের পাতা ঘুমে জড়িয়ে আসছে। মনে মনে সবাইকে ক্ষমা করেছে রাধারাণী। এমনকি তার বাড়ির ইঁদুর, শাক খেয়ে যাওয়া গরু-ছাগল, রায় বাড়ির অহংকারী গিন্নীকেও। কাল তার জন্মদিন। অল্প একটু ভাত, দুটো আলুসেদ্ধ, একটা লঙ্কা। পায়েস হল না। থাক, একটা বাতাসা ভাতের সাথে নিয়ে নেবে।
গ্রামে রেডিওতে যখন মহালয়া শেষ হব হব তখন রাধারাণী এ সংসার থেকে অনেক দূরে। গ্রামের লোকে জানল বেলা এগারোটা নাগাদ। সব জোগাড়যন্ত্র করতে করতে সন্ধ্যে হল। আকাশ ঘিরে মেঘ এলো। শুকনো পাটগুলো হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে উগ্র গন্ধে চারদিক ভরিয়ে দিল। বাগানের মধ্যে রাধারাণী খাটে শুয়ে। যেন ঘুমাচ্ছে। তাকে দড়ি দিয়ে বাঁধছে ক্লাবের ছেলেরা। হাসি-তামাশা হচ্ছে। কেউ জানে না বুড়ির মেয়ের নাম্বার যে তাকে খবর দেবে। মোবাইলে হিন্দী গান চলছে। সামনের রায়বাড়ির গিন্নী শিব মন্দিরে যাওয়ার আগে দেখে গেল আড়চোখে, কয়েকটা কচি ঝিঙে হয়েছে বেপারীদের উঠানে।
এখন রাধারাণী মাথাটা দুলিয়ে দুলিয়ে চলেছে শুয়ে শুয়ে। পাটের গন্ধ, ভাতের গন্ধ, পায়েসের গন্ধ থেকে অনেক দূরে একটা কোথাও। কারোর চোখে এক বিন্দু জল রেখে গেল না সে। তাতে কোনো ক্ষোভ আছে রাধারাণীর? নেই। সে কতবার ভেবেছে যে সে মরে গেলে তার মেয়ে-জামাই এসে জমি-জায়গা বিক্রি করে দেবে। এখানে অন্য কেউ থাকবে তখন। তা বলে কি তার কিচ্ছু থাকবে না? থাকবে। তার জন্মদিনের সাক্ষী তার থালা-বাসনগুলো। সে থালা-বাসনগুলোতে কেউ না কেউ খাবে তখন। রাধারাণীর তাতেই তৃপ্তি।