উনি দম আটকে এলেই জানলার দিকে চলে যান। পরনের লুঙ্গিটা হেঁচড়ে যেন খুলেই যাবে শরীর থেকে। গারদ দুটো আঁকড়ে ধরে নাকটা খোলা বাতাসে বার করে দেন। বিস্ফারিত চোখে সামনের পার্কটার দিকে তাকিয়ে বলেন, পরী... পরী..
পরী নেই। এই বৃদ্ধ মানুষটার বাড়ির সামনে পার্ক। পার্কে একটা স্লিপ। দুটো সি-স। আর কিছু ফুলগাছ। বৃদ্ধ'র রোগ COPD। মাঝে মাঝেই শ্বাস আটকে আসতে চায়।
বাড়িতে দু'বেলা আয়া। ছেলে ব্যাঙ্গালোরে। সেখানেই ফ্ল্যাট। সংসার। বউ। একটা বাচ্চা মেয়ে। অটিস্টিক।
সামনের পার্কে বাচ্চারা যখন খেলতে আসে, বৃদ্ধ জানলার গারদ দুটো ধরে নাকটা ঠেলে বার করে, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকেন। জোরে জোরে শ্বাস নেন। ওদের ডাকেন। কেউ সাড়া দেয়, কেউ দেয় না। মাসের প্রথম দিকে, পেনশানের টাকা ঢুকলে সবাইকে লজেন্স দেন। লজেন্স এনে দেয় রাতের আয়া। সে মেয়ের মত।
একটা বাচ্চা মেয়েকে ডাকলেই সাড়া দিত। সে তার কাজের মাসির সঙ্গে পার্কে আসে বিকালবেলা। মা-বাবা দু'জনেই কলকাতায় যায় কাজ করতে। কল্যাণী থেকে কলকাতা অনেক দূর। বাচ্চাটা বাবা বলে না, বলে বাপী। বৃদ্ধ তাকে নাম দিয়েছেন পরী। পরী ডাকলেই জানলার কাছে এসে দাঁড়ায়। মাথা তুলে জিজ্ঞাসা করে, দাদু তোমার ঘরে বড় টিকটিকি আছে? বৃদ্ধ মাথা নেড়ে বলেন, হ্যাঁ আছে দিদিভাই। পরী জিজ্ঞাসা করে, তুমি আজ ডিম খেয়েছ? কুসুমের রঙ কি ছিল? দাদু একদিন বলেন, লাল, একদিন বলেন গোলাপী। উত্তর দিতে দিতে কাশির দমক এলে মাথাটা সরিয়ে নেন ঘরের মধ্যে। এক-একদিন কাশির দমক থামতেই চায় না। কাশির উপর রাগ হয়। পরী অপেক্ষা করতে করতে পার্কে চলে যায় আবার। কাশি থামলে বৃদ্ধ আবার তাকিয়ে থাকেন জানলার গারদে গাল ঠেকিয়ে। চোখ ঝাপসা হয়। পরী দূরে স্লিপ বেয়ে নামছে। আবার উঠছে। সন্ধ্যে হয়ে আসে। বৃদ্ধের ঘরে সাদা টিউবের আলো জ্বলে ওঠে, সন্ধ্যের বন্ধুর মত। টিকটিকিটা বেরিয়ে আসে। বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করে অতীতের জীবনে বেড়াতে যান। রাস্তাটা সরু হয়ে আসছে। অতীতের জীবনের মানচিত্র কাউকে দেখানো যায় না। গোটাটা কেউ হাঁটেনি তো তার সঙ্গে।
লকডাউন শুরু হল। বাচ্চাদের আসা বন্ধ। এবারের থার্ড ওয়েভে ওদের নাকি আরো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা। বৃদ্ধ পেপার মুড়ে বালিশের পাশে রাখেন। চোখের জ্যোতি কম থাকলেও বুঝতে পারেন স্লিপের গায়ে ময়লা জমেছে। সি-স'তে জমেছে ধুলো। পার্ক আগাছায় ভরে গেছে। কেউ কেউ বসে বিড়ি খায়। মাঝে মাঝে পুলিশ এসে মাতালদের তুলে নিয়ে যায়। বৃদ্ধ'র চোখে ঘুম আসে না। রাতের বেলায় টিউব ঘুমায়। আলো বলতে রাস্তার আলোর এক টুকরো। মশারির ভিতর দিয়ে দেখেন বৃদ্ধ সেই আলো বেয়ে বাচ্চারা তার ঘরে ঢুকে পড়ছ। তার বুকের উপর রাখা সি-স। তারা দুলছে। বুকের উপর চাপ বাড়ছে। সুখ বাড়ছে।
বৃদ্ধ বোঝেন মাথার সুতো আলগা হয়ে যাচ্ছে। মানচিত্রের অনেক জায়গা অন্ধকার। ছেলের মুখ মাঝে মাঝে মোবাইলের স্ক্রিনে দেখে মনে পড়ে। সবাই দূরে চলে গেছে। তার নাতনি শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে। সে ঠা-দা ডাকে। শেখালে ডাকে। নইলে চুপ।
বৃদ্ধ আজ সকাল থেকে পার্কের দিকে তাকিয়ে। শ্বাস আটকে আটকে আসছে। ফাঁকা পার্কে এক দল কাক বসে ডাকছে বড্ড। কেউ এই রাস্তা দিয়ে স্কুলে যায় না আর সকালে। বৃদ্ধ গারদ দুটো শক্ত করে আঁকড়ে। অস্ফুটে ভেসে আসছে একটাই উচ্চারণ - পরী…. পরী... পরী…
দাদু, এদিকে ফেরো... ওনারা এসে গেছেন….
একদল মানুষ ঘরে ঢুকল। ভ্যাক্সিন দেওয়া হবে। বৃদ্ধ হাঁ করে তাকিয়ে। মাথাটার মধ্যে নাগরদোলা ঘুরছে। কিচ্ছু বুঝতে পারছেন না কি হচ্ছে। একজন অল্পবয়েসী মেয়ে সামনে এগিয়ে আসছে। কে? মা? বৃদ্ধ ফুঁপিয়ে উঠলেন। মা?... তুমি এসেছো?.... মা, আমার খুব কষ্ট... এখানে এখানে…. বৃদ্ধ বুকের উপর হাত বোলাচ্ছেন.. মা তাকে নিয়ে ডাক্তারখানায় এসেছেন, ডাক্তার ইঞ্জেকশন দেবে, তার খুব জ্বর।
বাঁ হাতে সূচ ঢুকল। বৃদ্ধ বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে নার্সের দিকে। চোখ দিয়ে দরদরিয়ে জলের ধারা। একবার বলছেন মা... একবার বলছেন পরী…..
আয়া নার্সকে বলছেন... আজকাল মাথাটা ঠিক থাকে না…... এই লকডাউনের পর থেকেই….
বৃদ্ধ শুনছেন না... শুধু নার্সের হাতটা শক্ত করে ধরে কেঁদেই চলেছেন... কেঁদেই চলেছেন…. একবার বলছেন পরী... একবার মা... একবার ঠা-দা….