মোড়েই বসতো সে। বসতো কোথায়? দাঁড়িয়ে থাকতো। সেই উনিশ বছর থেকে। বাপ মরে গেল টাইফয়েডে। সেই থেকে! এখন তার তিরিশ ছুঁইছুঁই।
আর সে থাকতো মোড়ের তিনটে বাড়ি পর। ওই যে গোলাপি বাড়ি। বাবা তার হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। সকাল বিকেল লাইন লাগে রুগীর। সে পড়তে যেত একা। আগে করতো বিনুনি। তারপর চুল ছাড়া। ঘাড় অবধি। চোখে চশমা।
একদিনও সে দোকানে আসেনি। গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ বসন্ত। একদিনও সে এদিকে আসেনি। এত উপেক্ষা!
অভিমান হত তার! মনের ভিতর তেঁতুল গোলা জল। টুপ্ টুপ্ করে ভিজিয়ে যেত মন। আবার শুকিয়ে যেত। সামনে দিয়ে যেত যখন। টুকরো হাসি, কি গায়ের সুবাস!
একদিন মেয়েটার বিয়ে ঠিক হল। বাবা এসে বলল, "তুমি ফুচকার স্টল দিও কেমন! টাকা নিয়ে ভেবো না। দেখো, নিন্দা যেন না হয়!"
ছেলেটার গলায় আটকালো দমকা হাওয়া কান্না। গেল না সে। ভাইকে পাঠালো। দু'দিন বেরোলই না ঘর ছেড়ে।
বছর ঘুরল কয়েক। ছেলেটার মাঝে মাঝেই আসে ঘুষঘুষে জ্বর। ক্লান্ত লাগে। মাথা ঘোরে। হাস্পাতালে গেল। ডাক্তার বলল, মারণ রোগ। সারবে না তো!
ছেলেটার সব বদলে গেল। দোকানে বসে। ক্লান্ত শরীরে ফুচকা বেচে। অকারণে কথা বলে সবার সঙ্গে যেচে যেচে। শুধু মেয়েটার কথা ভাবলে, চোখ ভরে আসে জল। কি হত, না হয় একটা ফুচকে খেল!
ছেলেটা দোকানে আসে না আর। শরীর দেয় না। ঘরের ভেতর ভাঙা স্বপ্নের নুড়ি। তাই দিয়ে ঘর ভাঙে, আবার গড়ে। একদিন ভাই বলল, শুনেছ দাদা! কি সাংঘাতিক খবর! ওই যে মেয়েটা, ডাক্তার যার বাবা, সে অকালে গেল গো করোনার ভীষণ ছোবল লেগে! একটা বাচ্চা ছেলে ছোটো… দুই কি তিন বছর হবে! কি যে হবে!
ছেলেটা শুনলো। চুপ করে। বলল না কিছু। বলার নেই তো কিছু। অনেক বলার ছিল। সব হারিয়ে গিয়ে ওপারে আছে জমে। অনেক কথা বলার আছে তাকে!
ঘর অন্ধকার। মধ্যরাত। তার প্রাণের মধ্যে ভীষণ তাড়া। তার সময় হবে কবে! উঠল বিছানা ছেড়ে! ভাইয়ের ঘরে গিয়ে ডাকল, ভাই ভাই….
ভাই চমকে এসে বাইরে দাঁড়ালো। দাদার কি সময় এলো তবে!
দাদা বলল, ছেলেটার বাড়ি জানিস? এক প্যাকেট শুকনো ফুচকা আসিস দিয়ে আমি চলে গেলে পরে। আর শোন…
ভাই তাকিয়ে, বিভ্রান্ত চোখ… মাথাটা কি খারাপ হল তবে!
ভাই, আমায় ডাক্তার ক'দিন যেন সময় দিয়েছে বলে!