সে হুইলচেয়ারে ছিল। নাম? সঠিক নামটা বলব না, আর নকল নাম দিতে ইচ্ছা নেই। প্লাস্টিকে মোড়া গোল গোল ভাজা বিক্রি করছিল। মেলার একদিকে দাঁড় করানো তার হুইলচেয়ার। বয়েস? হবে আঠাশ কি উনত্রিশ। বৃষ্টিভেজা দিন। গলায় সবুজ রুমাল জড়ানো। সবুজের উপর কালো চাকা চাকা ফুল ফুল জামা, মাঝে মাঝে ছেঁড়া, বাদামী রঙের হাফপ্যান্ট। হাফপ্যান্ট কেন? জানি না। তার ভাই, কুড়ি বাইশ বছর হবে, দাদার চেয়ারের কাছে এসে মাঝে মাঝে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে একটা মেয়ে আসছে। একটু দূরে দাঁড়াচ্ছে, প্রচণ্ড অস্থিরতাকে লজ্জায় চেপে রেখে। তাদের অনেক তাড়া। অনেক কিছু বাকি যেন। এদিকে রাত বাড়ছে।
গল্প করতে করতে সে হঠাৎ বলল, কি ইচ্ছা করে জানো... যদি নিজেকে কোলে করে ঘুরে বেড়াতে পারতাম...
বলতে বলতেই হো হো করে হেসে উঠল। মেলার বৃষ্টিভেজা নরম মাটিতে কয়েক কড় দেবে গেল তার চেয়ারের চাকা। একটু টাল খেল যেন। ধরে ফেললাম। তার তখন হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। ওদিকে মাদলের শব্দ। সাঁওতাল নাচ। গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে নাচছে। ওই তো তার ভাই। ওই তো সেই মেয়ে।
ছেলেটা বলল, আসলে আমাদের মা বাবা সেই ছোটোতেই মরেছে। এই চাকা লাগানো চেয়ার ক্লাব থেকে দিয়েছে। আমাকে কোলে নিয়ে কেউ বেড়ায়নি। ছোটোবেলায় ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে বেড়াতাম। হাঁটুটা দেখো। কাপড় বাঁধা থাকত। ভিক্ষা করতাম। কাঁচরাপাড়া, নৈহাটি স্টেশানে। তারপর গরিফায়। এক মেশোর বাড়ি ছিলাম কয়েক বছর। আমি একা। ভাই এখানেই ছিল। গরিফা স্টেশানেও ভিক্ষা করেছি।
আমি মাদল ঘেরা নাচ দেখছি। আমার সঙ্গে দেখছে এক গোছা তারা সারা আকাশটা ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে।
হাসিতে উপচানো চোখের জল মুছে বলল, এখন এই কাজ করি। বছর চার হল। এদিকে থাকি না। ব্যাণ্ডেলের ওদিকে থাকি।
পা দেবে আছে নরম মাটিতে।
বাড়ি ফিরব। তুমুল বৃষ্টি এলো। স্টেশানে বসে। আকাশের সব তারা হুইলচেয়ারে গড়িয়ে বাড়ি ফিরে গেছে।
তার একটাই ইচ্ছা, নিজেকে কোলে করে একবার ঘোরে। বাবা মা ঘোরানোর সময় পায়নি।
একটা সিনেমা দেখেছিলাম। তাকে তার মা বাবা ভাই সবাই ছেড়ে গিয়েছিল। পুরো গ্রামে সে একা। পোলিওর ভ্যাক্সিন দিতে এসেছিল, গ্রামের লোক পিটিয়ে বার করে দিয়েছিল। নাম মনে নেই সিনেমাটার।
সব ইচ্ছা পূর্ণ হয় না। কিন্তু ইচ্ছাগুলো বললে তারা একটা গল্প হয়। আলপনা হয়। যেমন দূরের আকাশের তারারা আমাদের গল্পে রূপ নিয়ে হয় সপ্তর্ষিমণ্ডল, কালপুরুষ... তেমন।