মাথায় ব্যাণ্ডেজ করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়ল ঠানদাদু। আশির উপর বয়েস। দোতলা বাড়ি। দিদা পাশের ঘরে শুয়ে। প্যারালাইজড।
উদিত চুপ করে বসে টুলে। বিছানার পাশে। এই ঘরের গন্ধ ভীষণ চেনা। ছোটোবেলা থেকে এ বাড়ি যাতায়াত। বুবুনদার কাছে অঙ্ক করতে আসত। বুবুনদা নেই। আত্মহত্যা করেছিল। ডিপ্রেশন।
হোয়াটস অ্যাপে অঞ্জলিকে বলল, আজ দুপুরে তুমি খেয়ে নিও। আমার মনে হচ্ছে না আসা হবে। রাতের আয়া আসবেন তবে আসতে পারব। দিনের যে, সে নতুন। তেমন কিছু জানে না। নার্ভাস হয়ে আছে। ওই রান্না করবে, খেয়ে নেব কিছু।
ফোনেও বলতে পারত। কিন্তু অঞ্জলির হতাশ গলাটা শুনতে ইচ্ছা করল না। আজ বিকেলে বেরোনোর কথা ছিল। দু'জনেই কাজ করে। আইটি-তে। সময় কোথায়? বাড়িতে থাকলেও সময় হয় না। ওয়ার্ক ফ্রম হোম।
দাদা চা….
উদিতের অন্যমনস্ক মন চমকে উঠল। মঞ্জু দাঁড়িয়ে। কাপটা অল্প অল্প কাঁপছে। মেয়েটা রোগা। বয়েস পঁচিশ পেরিয়েছে বলে মনে হয় না। দুটো রোগা কালো হাতে শাঁখা জড়ানো। উদিতের মনে হল যেন শিকল। কেন মনে হল বুঝল না। এটা মাঝে মাঝেই মনে হয়। মনে হয় কোথায় যেন সাফোকেটেড হচ্ছে।
তুমি কিছু খেয়েছ?
মঞ্জু অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, না, এই চা খাব এখন। দিদাকে খাওয়াচ্ছিলাম, তখনই তো… তখন ন’টা। আমি ঘাবড়ে গিয়ে আপনাকে কল করলাম… আমার রক্ত দেখলে…
মঞ্জু কাঁপছে আবার। এই সব মেয়েরা কেন যে এ রাস্তায় আসে।
তোমার স্বামী কি করে?
কোনো দরকার ছিল না এই প্রশ্নটার। সমাজে কে কোথায় আছে, তার উপর কিছু প্রশ্ন করা খুব সহজ হয়ে যায়। বিনা পরিচয়ে এরকম ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা অসভ্যতা। কিন্তু মঞ্জু'র তা মনে হবে না। ওর মনে হবে আমি আন্তরিক। আসলে আমি আন্তরিক নই। আমি অনুপ্রবেশকারী।
তেমন কিছু করে না। তবে যখন যে কাজ পায়…
বাচ্চা?
এটাও অসঙ্গত প্রশ্ন। আসলে উদিত থামতে পারছে না। থামলেই কালো কুয়াশা। বিষাদ বৃষ্টি। তার চাইতে এই তো সামনে খোলা জীবন। মঞ্জুর জীবন। দুঃখের জীবন। অপমানের জীবন। তার চাইতে অনেক বেশি। এই তো সুখ। খোলা মাঠে চরে খাওয়ার সুখ। নিজের ঘরে যখন দমবন্ধ অবস্থা।
একটা মেয়ে… আমার শাশুড়ির কাছে থাকে।
মঞ্জুকে আপাতত ছেড়ে দেওয়া যাক। বোর লাগলে আবার কথা বলা যাবে। চায়ে মিষ্টি একটু বেশি। চলবে। উদিতের এই ছত্রিশ হল। প্রি-ডায়াবেটিক। কিন্তু আজ চায়ে চিনি চলবে। আজ অনেক কিছু চলতে পারে। বন্ধ করা সামাজিক ইমেজ বড় বেমানান। তখন অন্ধকার জঙ্গলে পশুর বিচরণ। সমাজ মানুষের পশুত্বকে ভয় করে। নিয়মের পর নিয়ম বানায়। ফাঁকও রাখে। পশুকে বেশি চাপলে বিকার। সমাজে বিকার অনেক।
২
---
এগারোটা বাজে। দাদু ঘুমাচ্ছে। দিদাও। এই পরিবারের কাছে ভীষণ কৃতজ্ঞ উদিত। তার বাবা মারা যাওয়ার পর এই দাদুই তার যাবতীয় দায় নেয়। বাবা প্রাইভেটে সামান্য একটা কাজ করত। এই মানুষটা না থাকলে সে আর মা ভেসে যেত। মাকে সেলাই শেখায় দিদা। মেশিন কিনে দেয়। এখনও মেশিনটা আছে। মা নেই।
দোতলা বাড়ি। উপরটা বন্ধই থাকে। উদিত উপরে এলো। টানা বারান্দা। সামনে বিরাটির ব্যস্ত রাস্তা। নূপুরের আওয়াজ। মঞ্জু আসছে। দাদা, টিফিন করেছি। আসুন।
তিনটে পরোটা। পাশে ছোলার ডাল আর একটা অমলেট। এলডিএল মার্জিন থেকে অল্প বেশি। হোক। আজ চলবে। অনুপ আসবে একটু পর। অনুপ উদিতের বন্ধু। ডাক্তার।
মঞ্জু পাশে দাঁড়িয়ে আছে। উদিতের খাওয়া দেখছে। অঞ্জলিও দাঁড়ায়। স্নেহ আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য কি?
মঞ্জু ডালটা দারুণ হয়েছে। তুমিও নাও।
নিঃশব্দে মাথা নাড়ল মঞ্জু। উদিত না তাকিয়েও বুঝতে পারল। হঠাৎ দাদুর কাশির আওয়াজ এলো ঘর থেকে। মঞ্জু, “আমি দেখছি, আপনি খান”, বলে দৌড়ে ঘরে গেল। উদিতও উঠে বেসিনে হাতটা ধুয়ে ঘরে গেল। দাদু ফ্যালফ্যাল করে ছাদের দিকে তাকিয়ে। মঞ্জু বলছে, কেমন লাগছে এখন?
কোনো উত্তর নেই। উদিত কাছে গেল। ডাকল দু'বার। তাকালো না দাদু। খানিক বাদে আবার চোখটা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল।
উদিত খাবার টেবিলে এসে বসল। মঞ্জু নিজের অজান্তেই যেন সামনের চেয়ারটা টেনে বসল। মুখটা চিন্তিত। বলল, দাদুর কিছু হয়ে গেলে দিদাকে কে দেখবে? কি হবে? মানুষ ভাবে এক আর কি হয়ে যায়, না দাদা?
উদিত মঞ্জুর দিকে তাকিয়ে। মঞ্জু প্রশ্ন করছে না। নিজের জীবনের কোনো একটা উঁচু টাওয়ারে উঠে বাকি জীবনগুলো মাপতে চাইছে। আমরা সবাই তাই করি।
উদিত বলতে যাবে কিছু, কলিংবেল বেজে উঠল।
অনুপ এসেছে। ঘর চেনে। সোজা দাদুর ঘরে গেলো। কিছুক্ষণ দেখে বলল, আমার মনে হয় হাস্পাতালে শিফট করাই ভালো।
মঞ্জু আতঙ্কিত হয়ে উদিতের চোখের দিকে তাকালো। উদিত বুঝল ও কি বলতে চাইছে। এতবড় বাড়িতে এক বৃদ্ধাকে নিয়ে… যে কথাটা অবধি বলতে পারে না।
সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। দমদমে নার্সিং হোমে নেওয়া হবে।
৩
---
ভর্তি করতে করতে আড়াইটা বাজল। উদিত একাই এসেছে। অনুপ ফোন করে রেখেছিল, অসুবিধা হল না। একবার অঞ্জলিকে ফোন করবে ভাবল। ইচ্ছা করল না। বাড়ি ফিরতেও ইচ্ছা করল না। আবার ফিরে গেল। দাদুর বাড়ি। না, মঞ্জুর কাছে। মেয়েটার ভয়ার্ত মুখটা বড় টাটাচ্ছে।
মঞ্জু দরজা খুলল একরাশ বিস্ময় নিয়ে।
খেয়েছ কিছু?
মঞ্জু 'হ্যাঁ' বা 'না' কিছুই বলল না। বলল, আজ দিদা দুপুরে কিছু খেলো না। মুখটাই খুলল না। আমার মনে হয় দিদা জানেন, আপনার মনে হয় না?
না। কি একটা হচ্ছে উদিতের। সে তো দিদার কথা শুনতে আসেনি। সে এসেছে মঞ্জুর কথা শুনতে। উদিত সবার বিপদে আপদে যায়। অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়ালে নিজের মধ্যের ইনফিওরিটি কমপ্লেক্সটা চাপা পড়ে যায়। নিজেকে ওর্থফুল লাগে। অন্যের অসময় ভালোবাসে উদিত। কিন্তু এটা সেটা নয়। এখন বুকটা খামচে ধরে আছে এক আবেগ। শ্বাস দ্রুত হচ্ছে। মঞ্জুকে ভালো লাগছে দেখতে। মঞ্জুকে দেখতে চায়। এভাবে না। ভালোবাসায়। নেশায়। বিনা পোশাকে।
মঞ্জুর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়নি। ইচ্ছা না হলেও দিদার ঘরে এলো। শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে সামনে। তাকে দেখেই অস্থির হয়ে উঠল। জড়, অথর্ব শরীরটাকে নাড়িয়ে, পাশের ঘরে আঙুল দেখিয়ে বলতে লাগল, উঁ… উঁ…
মঞ্জুর চোখে জল।
উদিত বাইরে সোফায় এসে বসল। ধুলোর গন্ধ। ডাস্টিং হয় না। অঞ্জলিকে কি সে এমন ভালোবাসে? আকর্ষণ ছাড়া ভালোবাসা কি? আজকাল তাদের সম্পর্কে সেই ম্যাজিকটা নেই। সব বড্ড জানা। একটু আগে মঞ্জুকে… লজ্জা লাগছে। নিজের নীচ প্রবৃত্তি এই প্রথম না, আগেও দেখেছে। ওসব লুকিয়ে বাঁচতেও জানে। কিন্তু এই বন্ধ
ঘরে, মঞ্জুও কি তাকে চায় না? সমাজকে খুশি করার দায় কার?
মোবাইল অন্ করল। অঞ্জলির কোনো মেসেজ নেই। আদৌ কি চায় তারা নিজেদের? আদৌ কি নিজেদেরকে নিয়ে কনসার্নড? আসলে 'কনসার্ন' ব্যাপারটা ভীষণ বায়োলজিকাল, নয় তো ইকোনমিক্যাল। মর্যাসল হয় না বলছি না, অতটা সিনিক আমি নই, কিন্তু সে হাতে গোনা কেউ কেউ হবে।
উদিত মাথাটা এলিয়ে দিল। কনসার্ন যতক্ষণ শরীরের চাহিদা থাকে, ততক্ষণ আরেকজনের উপর একটা কনসার্ন থাকেই। সেটা ইনভেস্টমেন্ট। মন না পেলে শরীরের খেলায় তৃপ্তি নেই। মন পেতে ইনভেস্ট করতে হয়। হৃদয় অনেক সিরিয়াস ম্যাটার। ওসব চক্করে আমি নেই। আরেকটা কনসার্ননেস থাকে যদি ইকোনমিক্যালি ডিপেন্ডেন্সি থাকে তো। অঞ্জলির আর তার এত বছর প্রথমটা ছিল। এখন নেই। আর দ্বিতীয়টা কোনোদিনই ছিল না বলে সেটা আজ নতুন করে ভাবার কিছু নেই।
৪
---
মঞ্জু স্নানে গেল। উদিত সাবানের গন্ধ পাচ্ছে। মঞ্জুর শীর্ণ নগ্ন দেহ কল্পনায় মেখে আছে। মঞ্জুকে সে চায় না। কিন্তু একটা সম্মতিসূচক শারীরি খেলা চায়। পাগলের মত চায়। মঞ্জু বুঝছে না?
হয়তো চাইছে। মুখে বলতে পারছে না। উদিত জানে সে অনেকের থেকে বেশি সুপুরুষ। তবে? মঞ্জু কি সত্যিই চাইছে না?
বাথরুমের দরজা খোলার আওয়াজ হল। মঞ্জু বেরোলো। দোতলায় উঠছে। নূপুরের শব্দ আসছে কানে। অল্প অল্প মিলিয়ে যাচ্ছে। সময় চলে যাচ্ছে। সুযোগ চলে যাচ্ছে।
মঞ্জু চায়। বলতে পারছে না। তার শরীরে আদরের ছাপ নেই। সুখের ছাপ নেই। সেও তৃষ্ণার্ত। উদিতের চাইতেও তৃষ্ণার্ত। সুখ আর টাকা দুটোই কি চায় না? না চাইলে এমন বদ্ধ ঘরে সে নিজেকে আড়ালে রাখেনি কেন? বারবার সামনে কেন এসেছে? সে-ও চাইছে। চাইবেই। এটা বায়োলজি। এটাই ডেস্টিনি।
৫
---
মঞ্জু বেশি লড়াই করেনি। উদিত যখন বুঝল মঞ্জু চায় না, তখন সে আর ফিরে আসতে পারে না। তার ইগোতে লাগল। সে মঞ্জুকে তছনছ করে দিল। তার পরোটার ঢেকুর, অমলেটের ঢেকুরকে সামনে রেখেই। অম্বল হয়ে আছে। দোতলার মেঝেতে মঞ্জু শুয়ে থাকল। ভেজা শাড়িটা পাশে কুণ্ডুলি পাকিয়ে পড়ে। গামছাটা ছেঁড়া শিরার মত একদিকে এঁকেবেঁকে পড়ে। মঞ্জুর মুখের দিকে তাকালো না। কি একটা মাথার মধ্যে ঘুরছে। প্যান্টটা পরতে পরতে নীচে নামতে নামতে শুনলো গোঙানির আওয়াজ। দিদা। উদিত বিদ্যুৎগতিতে ঘরে ঢুকল। পাশে রাখা বালিশটা নিয়ে দিদার মুখে চেপে ধরল। হাত-পা টানটান হয়ে যাচ্ছে। সবাই মুক্তি চায়। সবাই সুখ চায়। এ পৃথিবী দুর্বলের না। মুখচোরার না। এ সাহস খানিক বাদেই আর থাকবে না নিজের। যা করতে হবে এখনই। দাদু ফিরবে না, ডাক্তারের কথায় বুঝে গেছে। আজকে বা কালকেই কিছু একটা হয়ে যাবে। এ মানুষটার কি হবে?
চোখদুটো খোলা। মুখটা হাঁ। জিভে একটা মুড়ি আটকে। দাঁতের ফাঁকে আটকে ছিল হয় তো।
পিছনে ফিরতেই দেখল মঞ্জু দাঁড়িয়ে। বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে। উদিত তার সামনে এসে দাঁড়ালো। তার ঠোঁটে একটা চুমু খেয়ে বলল, মুক্তি দিলাম তোমায়। এ যদি না যেত, আমি রোজ আসতাম, তোমায় নিতে। নিজেকেও মুক্তি দিলাম। এ কাপুরুষের জীবন বেঁচো না। মঞ্জু পালাও, পালাও। এভাবে সব সহ্য করে শুয়োরের মত বেঁচে থেকে কি লাভ? বাঁচো মঞ্জু…. শরীর বিকিয়েই বাঁচো… কিন্তু এভাবে না… আমি তোমায় রেপ করিনি, ইউজ করেছি। এই তার টাকাটা। তোমার উপার্জন। এর মধ্যে লজ্জা নেই। এরও একটা ডিগনিটি আছে, মানে মর্যাদা আছে।
উদিত ওয়ালেটটা থেকে একগুচ্ছ টাকার নোট বার করে মঞ্জুর পাশে টেবিলে রাখলো। মঞ্জু এখনো 'হাঁ' করে তাকিয়ে দিদার নিথর শরীরটার দিকে। নিজেকে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছে উদিত। ঘরে যেন তিনটে মৃতদেহ।
উদিত রাস্তায় এলো। বিরাটির ঘিঞ্জি রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। সিগারেট ধরালো। সন্ধ্যে হব হব। কোনো অনুতাপ নেই। অনুতাপ হবে যখন দুর্বল হবে। দুর্বল মনে সমাজ ঢোকে। কেন্নোর ডেলার মত করে নীতি আটকে বাঁচে মানুষ। কাপুরষের মত। মোবাইলটা অন্ করল, অনুপকে টেক্সট করল। 'ডান'। অনুপ রিপ্লাই দিল, স্কাউণ্ড্রেল। অঞ্জলিকে মেসেজ করল। ডেলিভারড হল না। মানে এখন সিনেমা দেখছে। হয় তো পাশে বসে পরপুরুষ। উদিত সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পিষে বলল, চুতিয়া।