গোঁসাই, যাকেই বসাই সেই খামচি দিয়ে যায়।
গোঁসাই
হাসল। বলল সাজিখানা আনো দেখি ঠাকুর ঘর থেকে।
সে এনে দিল।
ঠাকুরঘরে ঠাকুরের বিগ্রহ দেখে অভিমান হল।
গোঁসাই অল্প
অল্প করে আঁজলা ভরে পুকুর থেকে জল তুলে সাজি ধুলো। পুকুরঘাটে নামতে তিনটে সিঁড়ি।
শেষধাপে বসে উপরের দিকে তাকিয়ে বলল, আজ আকাশ বেশ পরিষ্কার
না গো? কদিন এমন বৃষ্টি হল, মনে হল যেন
এই পুকুরটাই সব আশ্রমজুড়ে থাকবে, আমরা হাঁসের মত ভেসে বেড়াব।
অলোক কথা
বলল না। তবে এটা ঠিক, তার এই বাহান্ন বছর বয়সেও শীতে এত বৃষ্টি
দেখেছে বলে মনে পড়ে না।
অলোকের বিয়ে
ভেঙেছে যৌবনের শেষে। খাপ খায়নি। তারপর থেকে কতবার ঘর বসাতে চাইল। কিন্তু ঘর তাকে
চাইল না। যে-ই এলো, সে বসারঘরের ভিতরে আর এলো না। বুকটা রাতদিন
খাঁ খাঁ করে অলোকের। সব কাজই করে, কিন্তু শান্তি নেই। সুখ
নেই। আনন্দ নেই।
গোঁসাই
পুকুরপাড় থেকে উঠে ফুলের বাগানে ঢুকল।
অলোক ঢুকল
পিছনে পিছনে।
গোঁসাই বলল, হৃদয় ফাঁকা রাখতে নেই। ভূতের বাসা হয়।
অলোক বলল, কাকে বসাই গোঁসাই। কাউকে যে বিশ্বাস করতে পারি না।
গোঁসাই বলল, দেখো, জটিল মনস্তত্ব আমি বুঝি না। তবে তুমি চিরকাল
সুখের পায়রা হয়ে যদি থাকতে চাও, তবে কে আসবে? সুখী হবে এ বিশ্বাস করতে পারো না, এ বুঝি। কিন্তু
কাউকে সমস্ত হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতে পারবে, এ বিশ্বাসও কি
হারিয়েছ?
হ্যাঁ, অলোক অন্যদিকে ফিরে বলল। তার চোখের কোলে জল ভরছে।
গোঁসাই বলল, এ খুব খারাপ লক্ষণ গো.. ভালোবাসা পাবে কি না পাবে গোবিন্দ জানেন... কিন্তু
নিজেকে উজাড় করে ভালোবাসা দিতে পারবে না, এ দৈন্য নিয়ে
বাঁচবে কি করে গো? ভালোবাসো... ভালোবাসো সখা…. প্রাণঢেলে ভালোবাসো…. শেষে সব শূন্য হলেও ভালোবাসো…
সে শূন্যের মান আছে... কিন্তু এই যে শূন্যতা বুকে নিয়ে বেড়াচ্ছ এ যে
রুক্ষতা গো... বরং ফসল কাটা মাঠের শূন্যতা ভালো…. বন্ধা
ক্ষেতের শূন্যতা বড় ভারি যে গো….
অলোক বলল, কাকে ভালোবাসব? কেউ নেই আমার….
গোঁসাই হো
হো করে হেসে উঠল…. বলল, বোকা রে আমার,
ঝর্ণার বেগেই নদী হয়... নদীর টানে আবার ঝর্ণা নামল কবে গো…. তুমি তোমার ভয় আশঙ্কা সরিয়ে ভালোবাসার আগল তো খোলো... শুধু মনে রেখো
ভালোবাসা মানে সুখ না, আনন্দ…. তবেই
শেষে দিনমজুরের মত হাত পাতবে না… বরং মালা গাঁথার শেষে,
মালা বিকিয়ে হাতময় ফুলের গন্ধ নিয়ে বাড়ি ফিরবে... বুঝলে গো….
অলোক বলল, তোমার শূন্যতা লাগে না?
গোঁসাই বলল, মাঝে মাঝে লাগে…. খুব লাগে…. তখন
আনন্দ হয়...বুঝি সে দ্বিগুণ বেগে আসবে বলে সব স্তব্ধ করেছে... ঝড় আসার পূর্বক্ষণ…
বুঝলে?...
না... আন্দাজ
করি... তুমি ভাবের মানুষ গোঁসাই… আমরা অভাবের….
গোঁসাই বলল, ও অভাবও একটা ভাব গো.. শুষ্কভাব… জগত কি ভাবছাড়া... যদ্দিন
চিন্তা করতে পারো তদ্দিন কোনো কোনো ভাবেই আছ….
অলোক বলল, আসি তবে…..
গোঁসাই বলল, ফাঁকাঘর রেখো না বাপু…. ফাঁপা বাঁশেও ফুঁ দিলে সুর
বেরোয়…. আর হৃদয়ে বেরোবে না?.... ভরসা
রাখো বাবা…. এসো…
অলোক ফিরছে।
গোঁসাই গাইছে, দাও ছেড়ে দাও ওগো আমি তুফান পেলে বাঁচি….