Skip to main content

 


 

'তাসের ঘর' হইচই'তে আসছে যখন শুনলাম, প্রথমে মনে হল তারাশঙ্করের? ইচ্ছা হল নতুন কোনো গল্প হলে হয় না, এই সময়ের, এক্কেবারে এই সময়ের? ফেসবুকে পোস্টগুলো দেখেও মনে হচ্ছিল, হয় তো তারাশঙ্করের শৈল এ নয়। এ হয় তো অন্য গল্প।

       গতকাল দেখলাম। হ্যাঁ, একেবারেই অন্য গল্প। একেবারে এই সময়ের গল্প। তাসের ঘর শুরু হতেই মোটামুটি দশ মিনিট পেরোনোর পর ভীষণ মনে হতে লাগল একটা সিনেমার কথা – উইট। এমা থম্পসনের আশ্চর্য অসামান্য অভিনয়। একজন ক্যান্সার আক্রান্ত মহিলার শেষ কয়েকদিনের গল্প, তার নিজের মুখে, দর্শকের দিকে তাকিয়ে। হ্যাঁ, উইট সিনেমার বৈশিষ্ট্যই হল দর্শক শুধু দর্শক থাকতে পারবেন না, আপনাকে বারবার চরিত্রটার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। খুব অস্বস্তি হলেও দাঁড়াতে হবে। শুনতে হবে। কারণ আপনাকে উদ্দেশ্য করেই যে বলে যাচ্ছে চরিত্র তার সব কথা। আপনার উপস্থিতি এখন তাই দর্শক হিসাবে না, উহ্য চরিত্র হিসাবেই।

       উইট সিনেমায় ছিল জন ডানের কবিতা। তাসের ঘরে এল রবীন্দ্রনাথ, গানে। দুটো গল্প জুড়েই কোথাও মৃত্যুর আনাগোনা। জীবন বারবার প্রশ্নচিহ্নের মুখে। অস্বস্তিকর প্রশ্ন। যে প্রশ্ন, যে সমস্যাগুলো, সংকটগুলোকে আমরা আমাদের দৈনন্দিন ব্যস্ততার আড়ালে ঢেকে রাখতে চাই, এড়িয়ে যেতে চাই। জীবনের স্রোত ভীষণ স্বার্থপর, সেই স্বার্থপরতায় সে জীবনকেই শোষণ করতে শুরু করে বিনা সংকোচে। আমরা তা করতেও দিই, কারণ আমরাও কি কম স্বার্থপর! কিন্তু সেই স্রোত যদি হঠাৎ কোনো কারণে থেমে যায়? তাসের ঘরের গল্পের পটভূমি এই স্রোতহীন অবস্থা – লকডাউন।

       তাসের ঘর সিনেমাটার দৈর্ঘ্য মোটে সাতচল্লিশ মিনিট। গল্পটা দু'জনে বলেছে – এক স্বস্তিকা আর দুই অয়ন শীল। দ্বিতীয়জন ক্যামেরায়। ক্যামেরা আর স্বস্তিকার অদ্ভুত যুগলবন্দী। কেন ক্যামেরার কথায় এলাম আগে সেই কথাটা বলি।

       লকডাউন, এক বাধ্যতামূলক স্থবির স্রোতহীন অবস্থা। মানুষের বিচরণক্ষেত্র সীমিত। তাই তার দৃষ্টি সেই ক্ষুদ্র বিচরণক্ষেত্রেই ভীষণ প্রকট, তীক্ষ্ণ, উগ্র। আবার উদাসীন, অস্থির, চঞ্চল। ক্যামেরা এই ভাষাটাকে স্পষ্ট করেছে। ঘরের এমন খুঁটিনাটি ফ্রেমে এসে পড়ছে যা সাধারণত আমাদের চোখে পড়লেও খেয়ালে পড়ে না, আবার দূরের মেঘলা আকাশও মাঝে মাঝেই ফ্রেমের মধ্যে এসে পড়ছে, যে শুধু আকাশ নয়, যে একটা ছুটির আহ্বান, বা মুক্তির। বেশ কিছু দৃশ্যে মনকে নাড়া দিয়ে গেছেন অয়ন। একজন চরিত্রের উপস্থিতিকে ‘নেই’ করে দিয়ে আরেকজন চরিত্রকেই কিভাবে বাদী স্বর করে তোলা যায় তা একটা স্বল্প পরিসরে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। একজন চরিত্রের কখন কতটা বাঙ্ময় হয়ে ওঠে, ফ্রেম ততটুকুকে অসামান্য ধরে রেখেছে। পর্দার ফাঁকে সিগারেটের উড়ন্ত ধোঁয়ায় ভোরের অপেক্ষায় ভোরের আলো ফুটে ওঠা – অসামান্য চিত্রায়ন। যখন সত্যিই ভোরের আকুলতা দর্শকেরও মনে জেগে উঠেছে গল্পের তাড়নায়।

       স্বস্তিকার অভিনয় অনেকবার ভালো লেগেছে আমার। তাসের ঘরেও লাগল। কারণ গল্পের মধ্যে দুটো স্বস্তিকা – এক বাইরের, আরেক ভিতরের। এই চরিত্রটাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলে – প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভনেস। স্বস্তিকার তাসের ঘরে অভিনয় এই প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভনেসের দুর্দান্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে। সরাসরি অ্যাগ্রেসিভনেস এর গল্পটা সোজা হয়। কিন্তু প্যাসিভের ক্ষেত্রে তা যেমন জটিল, তেমন অনেকগুলো মাত্রায় বিভক্ত সেটা। স্বস্তিকার অভিনয় সে মাত্রাগুলোকে ছুঁয়ে গেছে। ছুটির আকুলতা কেমন করে মুক্তির জেদ হয়ে উঠতে পারে, সে গল্প বলা খুব কি সোজা?

       আর গল্পটা? দেখে নিতে পারেন। সত্যি বলতে অনেকদিন বাদে একটা বাংলা সিনেমা দেখে মনটা বেশ স্বস্তি পেল, গল্প বলার কৌশল বড় অভিনব। আবেগের পাশাপাশি যদি বুদ্ধি এসে না বসে তবে তাতে পূর্ণ আনন্দ পাওয়া ভার। তা কি শুধু ডিটেকটিভ গল্পেই হয়? না, দৈনন্দিন জীবনেও সে উপাদান ছড়িয়ে আছে। একটু খেয়াল করে তাকাতে হয়। তাসের ঘর তাকিয়েছে। সংযতভাবেই তাকিয়েছে। তাই একটা অভিনব সৃষ্টি হয়েছে।