উঠান ঘেরা কয়েকটা বড় বড় গাছ। আম, জাম, কাঁঠাল। মাঝে একটা বাড়ি। দুটো বড় ঘর, একটা বারান্দা। টালির ছাদ। বাউলের বাড়ি।
মদনপুর স্টেশানে বাউল বসে। ভীষণ অসুস্থ। পাড়ার একটা ছেলে পৌঁছে দিয়ে গেছে। টোটো করে। মানুষের উপর অগাধ বিশ্বাস বাউলের। সব মানুষের উপর নয়। যেমন সব গাছে এক ফল ধরে না, তেমন সব মানুষে গোবিন্দর একই লীলা নয়। কিন্তু আদতে সব মানুষই গোবিন্দ।
বাউলের গলায় ক্যন্সার। শরীর সে রোগকে আপন করে নিয়েছে না রোগ বাউলকে আপন করে নিয়েছে বাউল ভাবে না।
বাউল ডাক্তার দেখাবে না?
বাউল হাসে, কবিরাজ দেখসে..... ওই কৃষ্ণনগরের ওদিহে একজন কবিরাজ আসে... ওই থেই ঔষুধ লয়ে আসি... কিছু কিছু খাতি পারি এহন... শামা চাল বুঝো...
না, বুঝি না বাউল...
ও এক রকমির চাল আসে.. গলা গলা হয়ে যায়... তাইথেই গলা দিয়ে নেমে যায়....
ভীষণ গরম, বাউলের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সাদা পাঞ্জাবি ঘেমে চাপ চাপ। বাউল ধুতিটাকে হাঁটুর উপর তুলে স্টেশানের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে। চোখদুটো ক্লান্তিতে বুজে আসছে। ট্রেন দেরি আছে। খবর হয়নি। বাউলের পাশে দুটো ব্যাগে রাখা দুই ব্যাগ কাঁঠাল, বাউলের গাছে হয়েছে। গন্তব্য হালিশহর।
ভর দুপুরে বাড়ির সামনে একতারার আওয়াজ, বাউল গাইছে লালনের গান। মানুষ খোঁজার গান – এই মানুষে সে মানুষ আছে। সে বেশ কিছু বছর আগের কথা। বাউলের শরীর তখন বেশ শক্তপোক্ত। বাউল বন্ধুত্ব পাতাল। সব বন্ধুদের সাথে বাউলের বন্ধুত্ব হল।
মানুষ খুঁজছে শিকার, মানুষ শিকার। বোকা মানুষ শিকার। মানুষের শিং নেই, বিষদাঁত নেই, কাঁটা নেই, হাতির মত প্রকাণ্ড একখানা ভয়াল দেহ নেই – মানুষের আছে বুদ্ধি। সেই বুদ্ধি তার শিং, বিষদাঁত, কাঁটা। মানুষ শিকারের জন্য। বাউল সেই শিকার হয়েছিল, বোকা ছিল বলে না, ভালোবেসেছিল বলে। পুত্র যখন পর হয়ে যায় তখন আর কিসের সংসার? বাউলের মধ্যে তাই একজন অভিমানী সংসারী। বাউল ঈশ্বরের তত্ত্ব মানুষের তত্ত্ব গুলিয়ে ফেলে। অভিমানের সুর বাউলের একতারায়। আত্মাভিমানও আছে। নেই শুধু ধর্মাভিমান। বাউল মানুষ বলতে মানুষই বোঝে, হিন্দু-মুসলিম বলতে বোঝে – সব গোবিন্দের লীলা। সবই গোবিন্দ। বাউলের সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী পৃথিবী বড় মানবিক। শ্রীরাধিকার আহ্লাদে সৃষ্টি। আহ্লাদ থেকে ভালোবাসা। বাউল গঙ্গার পাড়ে বসে থাকত শুরুর দিকে, যখন সুতো ছিঁড়ে পুঁথিগুলো তার চারদিকে গড়িয়ে গড়িয়ে বেড়াত। মন নেই কিছুতেই। বয়ে যাওয়া গঙ্গার জলের দিকে তাকাতে তাকাতে বাউলের মনের মধ্যে একটা চর পড়ে। সেই চরেই বউকে নিয়ে এই মদনপুরে এসে ঘর বাঁধে।
গুরু বললেন, সংসারের দিকটা তো দেখলি, এইবার এইদিকটা দেখ। গুরুর আশ্রম নবদ্বীপ, বাউলের পূর্বাশ্রম বীরনগর। বাউলের স্ত্রী বাউলকে ডাকে ‘বন্ধু’ বলে। সে বাউলের ভেকটা বুঝল, বাউলত্ব কি বোঝার দায় কিসের তার? সে শুধুই সহধর্মিণী। ওসব তত্ত্ববিলাস পুরুষের জন্য, তার জন্যে না। গাছে ফলটা পাকলে, ভালো রান্না হলে এখনও সে অকৃতজ্ঞ বড়লোক ছেলের জন্য প্রাণ টাটায়। বাপের আর কি? নাড়ির টান তো নেই। গোবিন্দর লীলা, এ কি লীলা? পুড়ে পুড়ে তার ভিতরটা রুক্ষ হয়ে গেছে। মিষ্টি সুর বেরোয় না। কাউকে দুটো ভালো কথা বলতে গেলেও গলা থেকে এমন ঝাঁঝ বেরিয়ে আসে, লজ্জা লাগে বাউলের বউয়ের, তবু নিজেকে বদলাতে পারে না। বাউলের বুকে শান্ত চর, তার বুকে আগুনগোলা।
বাউলের শরীর অনেক ভেঙে গেছে। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। জিভ জড়িয়ে আসছে কথা বলতে গেলে। চারদিক সন্ধ্যের অন্ধকার, ঘরের মধ্যে অল্প আলোর একটা বাল্ব জ্বলছে। বাউল দেওয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে। সারা শরীর জুড়ে একটা কম্বল জড়ানো। যখন তখন জ্বর আসছে। পাশে একটা টর্চ আর একটা গার্ডার দিয়ে বাঁধা ভাঙা মোবাইল।
অ সৌরভ... ভাই ভালো আসো?... আমার শরীলডা ভালো নাই দাদুভাই... তোমার জেঠিমা বাবা ভালো আসেন?... একবার দেখে যাও আমারে... আদিত্যরে... সুমনেরে... দেবাশীষেরে নিয়ে আইসানে...
বাউলের কিছু বলার নেই আর। বাউলের বুকে চর ভাঙার শব্দ। জীবন নদী মোহনায় এসে বাউলকে ডাকছে – আয়, সামনে নীল সাগরের জল, তার গোবিন্দ। বাউলের চোখে উদাসীনতা। বাউলের হাতেপায়ে কোনো চেষ্টা নেই। তার ঘর ভরতি তার অসমবয়েসী বন্ধুরা, যাদের সাথে তার কত ফষ্টিনষ্টি, আজ সব চুপ।
পাখাটা চালায়ে দাও... অদের গরম লাগাবানে... চা দাও... বিস্কুট আনা আসে না...
ঘরের মধ্যে কেঁদে পড়ল বাউলের স্ত্রী। চর ভাঙছ বাউল... আমায় কোয়ানে রেখে যাবা... আমি যে সব হারাব বন্ধু... তুমি সুস্থ হয়ে যাও বন্ধু... আমি আরো বাড়ি ভিক্ষা করে তোমার জন্য দুধের ব্যবস্থা করব... তুমি সুস্থ হয়ে যাও বন্ধু... আমারে কার কাছে থুয়ে যাবা...
বাউল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। এর উত্তর তোমারে গোবিন্দই দেবানে... বাউলের নীরব চোখে কোনো প্রার্থনা নেই, শুধু বিশ্বাস, স্থির বিশ্বাস। মৃত্যু তো ভালো বন্ধু, গর্ভের বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করেছ বন্ধু, আর মৃত্যুশোক পারবা না...? বাউল কিচ্ছু বলল না। বাউলের একতারা বলল, সাদা ধুতি বলল, হাড়গুলো মড়মড় করে আড়ামোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল।
ট্রেনের ঘোষণা হল, ডাউন কৃষ্ণনগর লোকাল। বাউল একজনকে বলল, আমায় একটু তুলে দেবে? দিল। বাউল জানত দেবে। গোবিন্দের জগতে কৃপার অভাব নেই, কৃপা চাওয়ার মানুষের অভাব। মানুষের বড্ড ‘আমি’ বোধ। বুদ্ধির আমি, অর্থের আমি, পাণ্ডিত্যের আমি – এইতে কৃপা আসে? না তো। গোবিন্দের সামনে শিশুর অসহায়তা নিয়ে দাঁড়াতে হয়। কৃপা চাইতে হয়। নিন্দা-প্রশংসায় কিচ্ছু আসে যায় না, মানুষের মধ্যে সে সোনার মানুষ আছে – তার নাগাল চাই। সে সোনায় কোথাও এক বস্তা মাটি চাপা, কোথাও দশ বস্তা। আবার কোথাও জ্বলজ্বল করছে সে খাঁটি মানুষ।
বিজয় সরকারের গান শুনসো? আমি শুনসি, আমার কাছে অনেক গান আছে, শুনবে?
শোনাও...
বাউলের একতারায় টান পড়ল ডান হাতের মধ্যমার। বাউল গাইছে, নশ্বর জীবনের কথা। বিজয় সরকারের লেখা। দরদের সাধন নেই, দরদীকে খোঁজো, দরদের সাগর উথলাবে। কি কয়েক মুঠো বুদ্ধির আলোর ঝলাকানিতে মুগ্ধ হয়ে বসে আছো মন, সে দরিয়াও নাও ভাসাও, সে দরিয়ায় সূর্যচন্দ্র অস্ত যায় না, সে আলোর সাগর।
বাউল মারা গেল একুশে অক্টোবর মধ্যরাতে। উঠানে সাজিয়ে রাখা হল বাউলকে খাটে, ভোরের আলো এসে পড়েছে বাউলের প্রসন্ন নিষ্প্রাণ মুখের উপর। পাখি প্রভাতী গাইছে। বাউলের স্ত্রী স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বাউলের অঙ্গসজ্জা করছে। কপালে চন্দন দিচ্ছে, পুরোনো কণ্ঠী বদলে নতুন পরিয়ে দিচ্ছে। পুজোয় নতুন ধুতিটা ভাঙা হল কই বাউল, সে ধুতিটা আনো, সে ধুতিটা পরেই বাউল যাবে শেষযাত্রায়।
বাউলের খাট উঠল। উঠল হরিধ্বনি – বল হরি, হরি বোল... বাউলের মাথাটা দুলছে ভোরের আলোয় মাখা হয়ে। তার উঠান তাকে বিদায় জানাচ্ছে, তার বাড়ি, তার নিজে হাতে লাগানো গাছপালা তাকে বিদায় জানাচ্ছে... একতারা কেঁদে বলছে বাউল আমি যে রয়ে গেলাম..... বাউল বলছে, বিশ্বের মূলে যে সুতোটা বাঁধা আছে তাই নিয়েই তো আমি বেঁচেছিলাম – ভালোবাসা, সে সুর তো তুমিই শিখিয়েছিলে ভাই। আমি আসি, তুমি সময় হলে এসো।
বাউলের খাট উঠল। মুষ্টিমেয় কয়েকজন এসেছিল। একজন গরীব মানুষের শ্মশানযাত্রী কতজন আর হয় বাউল? আমাদের সময় নেই। আমাদের কথা রাখার দায় নেই। গরীব মানুষ দয়ায় বাঁচে – আমাদের খেয়ালের দয়ায়। আমাদের অনেক কাজ বাউল। আমাদের সারাদিন অনেকের মন জুগিয়ে, কর্তব্যের রঙীন কাপড়ে ঢাকা খেলনাগুলো সাজিয়ে সাজিয়ে খেলতে হয়, নইলে আমার ভয়, সবাই আড়ি করে চলে যাবে বাউল, আমি একা পড়ে থাকব। আমার বুকে যে কোনো চর নেই বাউল। একা হব কিসের জোরে?
বাউল কাঁঠালগুলো নিয়ে নামল হালিশহর স্টেশানে। ফোন এলো...
অ সৌরভ... কাউরে একডা গাড়ি নিয়ে পাঠাও দাদুভাই... আমি এতগুলান কাঁঠাল নিয়ে এসেছি, গাছে ধরেছিল... আমি আর কি দিতে পারব দাদুভাই...... আমার শরীলডা বড় ক্লান্ত... নইলে নিজেই...।