- মায়ের জন্য তর্পণ করতে গেলে না?
- না কাকু/কাকিমা/দিদা/দাদু/পিসী/পিসে... [দীর্ঘ প্রশ্নকের দল]
- কেন?
- ইচ্ছা করেনি। মন চায়নি।
- তোমার মায়ের জন্য এটুকু করা তোমার তো কর্তব্য বাবা...
- মনে হয়নি।
- তুমি কি কমরেড?
- কমরেডরাও তর্পণ করে। আমার কাকা বাবা দু'জনেই বর্তমান ও অতীত কমরেড... দেখুন গিয়ে গঙ্গায় গলা জলে দাঁড়িয়ে তর্পণ করছে।
- বুঝলাম। তুমি যাওনি কেন?
- ওই যে বললাম, মন চায়নি। সংস্কৃত বুঝি না। আমার মা বুঝতেন না। পুরুত আমার মাকে চেনে না। আমি পুরুতকে চিনি না। পুরুত জ্যান্ত। আমি জ্যান্ত। তা যে লোকে গেলুম না তার খবর সে পায় কি করে?
- হুম। তা মন্ত্রের একটা শক্তি আছে মানো তো?
- কিরকম?
- কিরকম আবার? এতে মন শুদ্ধ হয়। আত্মা তৃপ্ত হয়। তর্পণ মানে তৃপ্ত করা, কিস্যুই তো জানো না...
- বুঝলাম না। আমার মা আমাদের ছেড়ে মাঝপথে পাড়ি দিলেন, মানে দিতে বাধ্য হলেন (রোগের জন্য), তাঁর আত্মা বলে যদি কিছু থেকে থাকে, এবং যদি ধরে নিই সে আত্মার স্মৃতিশক্তিও আছে, তবে তো এটা আমার মাথাতেই ঢুকছে না, সে কি করে চারটে সংস্কৃত শব্দ আর দু'ঘটি গঙ্গাজলে তৃপ্ত হয়ে যাবে? আমারে কি মদন পাইসেন?
- তবে কিসে তৃপ্ত হবে শুনি?
- আমার জন্য রেঁধে... আমায় গালাগাল করে... বাবার সাথে বসে সিনেমা দেখে... আরো কত কি...
- এসব জাগতিক কথাবার্তা... এসব আত্মার চাহিদা নয়...
- তবে কি চাহিদা একজন পুরুতের দুর্বোধ্য ক'টা কথা আর এক ঘটি জল?
- এটা বিশ্বাসের কথা...
- কোনটা? আত্মাটা না মন্ত্র-জলের কেসটা?
- দুটোই...
- হে হে... প্রথমটাতেই যখন বিশ্বাস নেই তখন দ্বিতীয়টাতে... আর তা ছাড়া আত্মা থাকলেও... যদি সে ভালোবাসতে জানে বা ভালোবাসা বোঝে... সে আমার চোখের জলে রোজ তর্পিত হচ্ছে...
- সে না হয় হল, কিন্তু সংস্কৃতি বলে তো একটা কথা আছে না কি?
- সেটা কি? যা চলে আসছে তাই করে যাওয়া? মানে বামুন ধর্মের সংস্কৃতি...
- তা কেন? তোমার নিজের ঐতিহ্যের উপর শ্রদ্ধা নেই... যত শ্রদ্ধা বিদেশী কালচারের উপর... মানে ওরা টর্পণ করিটে যাইলে... হামি ভি যেটাম...
- সে গুড়ে বালি কত্তা... এসব পুরোনো ডায়লগ...
- তুমি অনেকের আবেগকে আঘাত করছ?
- আর আপনি যে আমার সাধারণ বুদ্ধি আর বিচারকে আঘাত করতে চাইছেন... তার বেলা?একটা গল্প শুনেছেন নানকের?
তিনি একবার বেণারসে একটা ঘাটে এসেছেন। দেখেন সবাই জলের অঞ্জলি দিচ্ছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন...কি করছ এগুলো তোমরা? তো সবাই বললে, তর্পণ। পূর্বপুরুষদের তুষ্ট করছি।
তা তিনি তাড়াতাড়ি আঁজলা আঁজলা জল নিয়ে পিছনে ছুঁড়তে লাগলেন। সবাই জিজ্ঞাসা করল...আরে এটা কি করছেন এরকম করে পূর্বপুরুষদের জল দেয় না।
তা তিনি বললেন, আরে ভাই আমি আমার চাষের ক্ষেতে জল দিচ্ছি। তারা অবাক। বলে, সে কোথায়? নানক বললেন, কেন পাঞ্জাবে!
সবাই হো হো করে হেসে উঠে বলল, আরে এর মাথাটাই বিগড়েছে, এখান থেকে ছুঁড়ে জল পাঠাচ্ছে পাঞ্জাবে।
নানক হেসে বললেন, তা ভায়ারা, যদি তোমাদের জল এই লোক থেকে পরলোকে যেতে পারে, তো আমার জল এখান থেকে পাঞ্জাব অবধি যেতে পারে না!
- তুমি তো বাপু আচ্ছা ছোকরা হে, ভগবান মানো না আবার নানক মানো?
- মানে বলতে চান, গল্প মানিনে গল্পকারকে মানি? ব্যাপারটা ঠিক তা না কত্তা...
মানুষের মধ্যে একটা শুভবুদ্ধি চিরটাকাল আদাড়ে বাদাড়ে পথ দিয়ে মানুষকে যে দীপ হাতে করে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে, এ বিশ্বাস করি। সে প্রদীপ শতকোটিবার নিভু নিভু হয়েও যে নেভেনি সে সাক্ষী ইতিহাস। সে দীপের শিখা যুগে যুগে বহু মহাপ্রাণ নিজের পাঁজর জ্বালিয়ে রক্ষা করে এসেছেন..তাও মানি।
তবে কি জানেন? সেই প্রদীপের আলোর সামনে নিজেদের আড়াল টেনে, কিম্ভুত কিম্ভুত ছায়া তৈরী করে, আর সেই ছায়াগুলোর গল্প বানিয়ে বিশ্বাস করতে বললে চটে যাই দাদা। তার চেয়ে বরং আপনি পরলোকের পূর্বপুরুষদের গল্পে মজুন, আমি হ্যারি পটার দেখি..আধুনিক যুগের আষাঢ়ে গপ্পো......ওই একই হল...
সৌরভ ভট্টাচার্য
30 September 2016