তার্কিক যুক্তি আর কাব্যিক যুক্তি। তার্কিক যুক্তি ততটা নিজের জন্য নয়, যতটা অন্যের জন্য। সে ভীষণ নিটোল। শিকলের পর শিকল বেঁধে এগিয়ে যাওয়া। শিকলে ঘেরাও নিজেকে। আর আছে কাব্যিক যুক্তি, সে সম্পূর্ণ নিজের জন্য।
সংসারে জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদ এর দ্বন্দ্বে চলতে চলতে হৃদয় কোথাও একটা এ সবের মানে খুঁজতে চায়। কিন্তু সে মানে তার্কিক যুক্তির গম্য নয়। সে চায় কাব্যিক সত্যকে। তার্কিকের সত্য তো তথ্য, সে শুষ্ক। কাব্যের সত্য রসসিক্ত। তাকেই চায় সে। শুধু করুণ রসে নয়, ভয়াল রসেও। তখনই তার মানসলোকে জন্মায় নটরাজ। নৃত্যরত নটরাজ। ধ্যানরত শিবে সবটা ব্যাখ্যা হয় না। সে শান্তরস। কিন্তু নটরাজের নৃত্যে আছে প্রলয় আর সৃষ্টি একই সঙ্গে। যা সৃষ্ট হয়েছে তা ধ্বংস হবে এই তো নিয়ম।
রবীন্দ্রনাথের লেখায় নটরাজের উল্লেখ আজীবন। সে নাটকে হোক, কি গানে, কি কবিতায়। রুদ্রকে দেখেছেন নটরাজে। নৃত্যের তালে তালে। “মোর সংসারে তাণ্ডব তব কম্পিত জটাজালে।”
সংসারে তাণ্ডব নৃত্য দেখেছি তো। শ্মশানে দাঁড়িয়ে থেকে, দাহ করে ফিরে এসেছি হৃদয়ের এক একটা টুকরো তো কতবার তো আমিও। রবীন্দ্রনাথের অক্ষরের দীক্ষায় নটরাজকে দেখছি জগত জুড়ে। নিজের প্রাণে। মৃত্যুও তো কবির কাব্যিক যুক্তিতে নটরাজেরই নৃত্য। নিষ্ঠুর নৃত্য।
একটা কবিতা, বড় নির্মম, বড় উদাস করা, অথচ ভীষণভাবে আত্মশক্তি ফিরিয়ে দেওয়া মনে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথের। গতকাল সারারাত জুড়ে মনে পড়েছে। আজীবন হয় তো মনে পড়বে। যখনই সংসারকে একটু দূর থেকে দেখার দরকার হবে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন মৃত্যুর কয়েক মাস আগে। ১৯৪১ সালের, ফেব্রুয়ারী মাসে।
"বিরাট সৃষ্টির ক্ষেত্রে
আতশবাজির খেলা আকাশে আকাশে,
সূর্য তারা ল'য়ে
যুগযুগান্তের পরিমাপে।
অনাদি অদৃশ্য হতে আমিও এসেছি
ক্ষুদ্র অগ্নিকণা নিয়ে
এক প্রান্তে ক্ষুদ্র দেশে কালে।
প্রস্থানের অঙ্কে আজ এসেছি যেমনি
দীপশিখা ম্লান হয়ে এল,
ছায়াতে পড়িল ধরা এ খেলার মায়ার স্বরূপ,
শ্লথ হয়ে এল ধীরে
সুখ দুঃখ নাট্যসজ্জাগুলি।
দেখিলাম, যুগে যুগে নটনটী বহু শত শত
ফেলে গেছে নানারঙা বেশ তাহাদের
রঙ্গশালা-দ্বারের বাহিরে।
দেখিলাম চাহি
শত শত নির্বাপিত নক্ষত্রের নেপথ্যপ্রাঙ্গণে
নটরাজ নিস্তব্ধ একাকী।"