Skip to main content

"আমি এখন তোমায় অল্প অল্প বুঝতে পারছি"

 

"তাই হয়, আমারও বিয়ের বেশ কয়েক বছর পর মনে হত তোর দিদাকে অল্প অল্প করে বুঝতে শুরু করলাম। এখন আরো বেশি বেশি মনে হয়। তোর দিদার সারাদিনের টুকিটাকি ঘটনা, এই যেমন ধর রান্নাঘরে রান্না করতে করতে বাসনগুলো মেজে ফেলা, উনুনে আঁচ দিয়ে সামনে বসে উদাস তাকিয়ে থাকা, অঞ্জলি দিতে গিয়ে চোখে জল আসা, আমাদের বকার ঝাঁঝে কিছু অপ্রিয় সত্যি বলে ফেলা, আবার সেগুলো ঢাকার চেষ্টা করা…. কত কি…."

"আমারও তাই মনে হয় জানো…. আমিও যেন তোমায় বুঝতে পারছি…. অল্প হলেও... আগে মনে হত তুমি আমায় বুঝতে না, ভীষণ একগুঁয়ে, ইগোয়েস্টিক। এখন মনে হয় ঠিক তা নয়... আমিও রনিতাকে নিয়ে ভীষণ পজেজিভ বিহেভ করি মাঝে মাঝে, সেটা ভয় থেকে জানো... কি একটা অমূলক ভয়... ও চীৎকার করে, একটা ইলেভেনে পড়া মেয়ে সেটা করবেই…. আমিও তো করেছি বলো? আমিও ভাবতাম আমাদের সময়ের এত কিছু এনজয় করতে পারোনি বলে তুমি এরকম রিয়্যাক্ট করো…. কি অবুঝ না আমরা?"

"হ্যাঁ রে। উপনিষদে আছে না, অসতো মা সদগময়... আমার স্কুলের একজন শিক্ষক বলতেন, আমাদের সারাটা জীবনই এই অবুঝ থেকে বুঝে যাওয়া…. কিন্তু বড় কষ্টের রে…. শিকড় উপড়ালে মাটির কি বল, যা যায় গাছেরই তো যায়…."

"হ্যাঁ মা…. তা যায়... রনিতার বাবার মুখটা ভাবলে আমার বুকটা ধক্ করে, সেদিন পায়ের তলার মাটি চলে গিয়েছিল মনে হয়েছিল…. সব শূন্য চারদিক... আমায় যেন সুন্দরবন থেকে এনে এই শহরে ছেড়ে দিয়েছে…. ধীরে ধীরে সবটা সামলে গেল... মেয়েটা বাবাটাকে চিনল না এইটাই যা….. মা আমি পারব তো?…."

জয়িতা কান্নাটা সামলে নিল। অভ্যাস হয়ে গেছে এখন। রমা রাস্তার দিকে তাকিয়ে ঝুলবারান্দায় বসে, সামনে দুটো ফাঁকা চায়ের কাপ।

রমা বলল, "পারবি... মানুষের মধ্যে মানু্ষের জানার বাইরে অনেক ক্ষমতা থাকে রে... সেটা সময় না এলে মানুষ বোঝে না…. যখন বোঝে তখন ভাবে আগেই কেন সব আশঙ্কার বারণ ছুঁড়ে ফেলে রাস্তায় নামেনি... এত ক্ষমতা তার নিজের ভিতরে? মানুষ অবাক হয়…. কিন্তু সময় না হলে কিছু হওয়ার নয় রে…."

"জানি... আজকের আমি আর সেদিনের আমির পার্থক্য দেখলেই বুঝি…. পুড়ে পুড়ে এই জায়গায় এসেছি মা…."

"দেখ, আমি এই জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় কেন বলতো প্রতিবার জয়রামবাটি আসি? নিজেকে আবার উজ্জীবিত করতে... দেখ সেদিনের কথা ভাব... একজন গ্রামের তথাকথিত বিধবা মানুষ…. একদিকে জয়রামবাটি আর আরেকদিকে বাগবাজার - এই দুইকে রেখে কিভাবে ব্যালেন্স করে চলে গেল…. কি আশ্চর্য লাগে না? কোনো চালাকি না, কোনো ওভারস্মার্টনেস না, শুধুমাত্র কি এক আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করে কারোর কাছে মাথা না নুইয়ে লড়ে তো গেলেন!"

"আমি ভাবিনি তো এভাবে?"

"সে-ই। আমিও ভাবতাম না আগে। এখন যত দিন যাচ্ছে তত ভাবছি। কিভাবে পারতেন? বিশ্বাস রে মা, বিশ্বাস... এই যে এতটা রাস্তা পেরিয়ে এলাম... কিসের জোরে বল...? আমার মনে হত আমি পারব... তোদেরকে মানুষ করতে ওই যৌথ পরিবারে খুব সোজা তো ছিল না রে... তোর কাকারা খুব সুবিধার মানুষ ছিল না... তাছাড়া তোর বাবারও যে খুব উপার্জন ছিল তা নয়... এদিকে রান্না একসঙ্গে... তোকে সবসময় তোর কাকার মেয়ের পরে মাছ দেওয়া হত, ও যেটা চাইবে ওকে আগে দিয়ে... কারণ ওর বাবার রোজগার বেশি... স্কুলে পড়ানো নিয়ে কত কথা শুনতে হয়েছে রে... আমি কি সাধে শাড়ির ব্যবসাটা ধরলাম... যাতে তোর আর তোর দাদার কোনো অসুবিধা না হয়…"

"দাদাকে আমি বুঝলাম না জানো... এত স্বার্থপর মানুষ হয় কি করে গো?…. লোকে বলে বৌদির জন্য... তুমি বিশ্বাস করো?"

"দেখ মা, অরুণ তো মাটির দলা না যে যেমন খুশি কেউ গড়ে নিল... না তো সাদা কাগজ যে যা খুশি রঙ করে নিল... কোথাও আমাদের ভুল ছিল হয় তো... আর কিছুটা তো মা মানুষ নিয়েই জন্মায়... তোর কাকার মেয়েটা, জাহ্নবী… কি চমৎকার হয়েছে বল... বাবা-মায়ের স্বভাব পেলে ও হত এরকম? ও ছবি তুলতে কোনদিকে গেল রে?"

"জানি না... বলল তো দুপুরের মধ্যে এসে যাবে…."

"মেয়েটা বিয়েটা যে কেন করল না…"

"ভালোই করেছে গো... ছাড়ো তো…"

"হ্যাঁ রে, আজকাল আর ভাবি না... আগে ভাবতাম… এখন বুঝি শুধুই সময় নষ্ট…"

******* ********* ********

"উফ্, এই একটা খাটে তিনজনে শোয়া যায়? তোরা যে কি ছেলেমানুষী করিস না…"

"চুপ করো তো রমাদেবী... জোনাকি দেখো... আর তোমার মেয়ের সঙ্গে সারাটা সকাল কি বকলে বলো তো... চোখ তো যা ফুলিয়েছ... যেন রাঙাজবা…. বলি এত কান্নাকাটি না করে আমার বাবা-মাকে নিয়ে চাট্টি আলোচনা করতে পারতে তো... গুণগান…"

রমা জাহ্নবীর মাথায় একটা চাঁটি মেরে বলল, "চুপ কর অসভ্য মেয়ে... বাবা-মাকে ওরকম বলতে নেই…."

"হ্যাঁ রে জাহ্নবী… তুই সত্যিই বিয়ে করবি না?"

"না…"

"কেন?"

"কারণ ওর দিল টুট গেয়া...", জয়িতা ওপাশ থেকে বলল।

জাহ্নবী বিছানায় উঠে বসে বলল, "তুই কি জ্যোতিষ চর্চা করছিস নাকি র‍্যা... আমায় বিয়ে করবে কার ঘাড়ে ক'টা মাথা?.."

রমা বলল, "তোদের বয়েস হয়েছে রে... ভুলে গেছিস নাকি... চুপ করে শো…."

রমা বলল, "তুই দীক্ষা নিবি?"

"না রমাদেবী... আমি নাস্তিক... তুমি ভুলে যাও কেন বারবার?"

"কি জানি রে, আমার বিশ্বাস হয় না…. তুই এই যে জয়রামবাটি আসিস প্রতি বছর… তোর মাকে কি মনে হয়?"

"কিচ্ছু না…. একজন মানুষ যে নিজেকে নিয়ে ভীষণ সিওর ছিল... আ ভেরি স্ট্রেট ফরোয়ার্ড লেডি…"

"ব্যস…!"

"তো কি? আমার ওসব জগৎমাতা-টাতা বোধ আসে না জানো তো... কিন্তু জেরুজালেম যেমন যীশুর নানা কীর্তির স্থান... এও তেমন… আনকণ্ডিশানাল লাভ....সেটা তো মানি.."

"ভালো বললি তো... জেরুজালেম আর জয়রামবাটি…."

"আসলে কি জানো রমাদেবী…. ভক্তির চাদরে ঢেকে মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে। সেন্টিমেন্টালিজম আর ভক্তি তো এক নয় রে বাবা! তবে তো রামকৃষ্ণ ঠাকুর যাওয়ার পর উনি কেঁদেকঁকিয়েই জীবন কাটাতেন। এমনকি অত দারিদ্র‍্যের মধ্যেও ঠাকুরের কোনো শিষ্যকেও জানাননি যে উনি কি দুরবস্থায় আছেন… নিজেকে নিয়ে অসম্ভব একটা সিওরিটি না থাকলে এটা পসিবল?"

"ঠিক রে…"

"এই রাস্তায় হাঁটতে যাবে?"

"এখন, এত রাতে?"

"চলো না… যাবে?"

"কুকুর আছে.."

"থাকুক…"

********* ********* *********

রমা বলল, "সত্যিই রাস্তায় বেরিয়ে কোনো ভয় করছে না তো রে…"

জাহ্নবী জয়িতার হাতে হাত ঢুকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, "লাগে না রমাদেবী... মাই গ্র‍্যাণ্ড জেঠিমা... ওটা মনের অভ্যাস... ভয় পাওয়াটা…"

জয়িতা বলল, "তুই বড্ড অন্যরকম রে…"

জাহ্নবী বলল, "দেখ আমি যা, আমি তা, তুই প্লিজ রনিতাকে ন্যাকা বানাস না... আর যাই বানা…"

"দেখো মা... আমি নাকি রনিতাকে ন্যাকা বানাচ্ছি…"

"না আসলে তুই খুব ন্যাকা তো…"

"দেখেছো…"

রমা হাসল। কিছু বলল না। হাঁটতে হাঁটতে মন্দিরের কাছে চলে এসেছে তিনজনে। কুয়াশায় অল্প অল্প ঢাকা চূড়োটা। কমলা ক্রিমের মত আলো সারাটা রাস্তায় ছড়িয়ে।

রমা হাতজোড় করে প্রণাম করল। জয়িতাও করল। জাহ্নবী হাঁটু মুড়ে বসে রাস্তার কুকুরগুলোর ছবি তুলছে। জয়িতা আর রমা চুপ করে দাঁড়িয়ে। একটা বিশ্বাস চাইছে, প্রাণপণে একটা বিশ্বাস চাইছে, একটা শিকড় যা বুকের অনেক নীচ অবধি যায়। ঝড়ে উপড়ে পড়ে না।

অনেক রাত হল। রমার হাঁটুটা টনটন করছে ব্যথায়। এতটা ফিরতে হবে ভাবলেই কান্না পাচ্ছে। জয়িতা বুঝল, বলল, "মা ব্যথাটা বেড়েছে না?"

জাহ্নবী দূরে কোথায় ছবি তুলছে। দেখা যাচ্ছে না। রাস্তা শুনশান। দেখতে দেখতে জাহ্নবী চলে এলো। রমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, "তেলটা এনেছ?"

রমা হাসল। আনা হয়নি।

রমা ধীরে ধীরে পা ফেলে হোটেলের দিকে এগোতে লাগল। দু'হাতে জয়িতা আর জাহ্নবীকে ধরে। হঠাৎ পিছন থেকে একটা টোটো এসে দাঁড়ালো। বলল, "হোটেলে ছেড়ে দেব?"

এত রাতে? রমার চোখের কোল চিকচিক করে উঠল। জাহ্নবী রমাকে টোটোতে তুলে দিতে দিতে বলল, "মা কিন্তু গিরিশের চ্যালাকে পাঠিয়েছে মনে রেখো... গন্ধ আছে…"

রমা দেবী বলল, "মায়ের ভাঁড়ারে সব আছে রে... কখন কাজে লাগবে মা'ই জানেন..."