Skip to main content

বাবা জল খাবে?

না। সতীশ মাথাটা ঝুঁকিয়ে বসে। নাম বত্রিশে। এখন চলছে আঠারো। এক একজন পেশেন্ট সময় নিয়ে দেখেন ডাক্তারবাবু।

আচ্ছা দে...

সতীশ জল খেতে খেতে বিষম খেলো। সুজন তাড়াতাড়ি ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে বাবার পিঠটা টানতে টানতে বলল, চলো একটু বাইরেটা ঘুরে আসি।

সতীশ আর সুজন বাইরে এলো। রাস্তায় ভিড়। দূরে হাওড়া ব্রীজটা দেখা যাচ্ছে। মাথাটা শুধু। সতীশ সারা জীবন হাওড়া স্টেশানে কাটিয়েছে। টিকিট চেকার ছিল।

সুজন চা এনে দিল। চায়ে চুমুক দিয়ে সতীশ ঘড়ি দেখে বলল, মুম্বাই মেলের ছাড়ার সময় হল।

সুজনের মাথায় কি একটা খেলে গেল। একটা ট্যাক্সি ডেকে বাবাকে বলল, ওঠো।

সতীশ বলল, ডাক্তার...

সুজন বলল, পরে হবে।

দুটো প্ল্যাটফর্ম টিকিট কেটে বড় ঘড়িটার নীচে এসে দাঁড়ালো দুজন। সতীশ বাচ্চা এখন। চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। যেন মেলায় এসেছে। সুজনের মনে হল যেন সত্যি সত্যিই একটা বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে এসেছে মেলায়। সতীশকে জিজ্ঞাসা করল, কি খাবে?

সতীশ বলল, কফি আর কেক।

সতীশ কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, চল সাউথের নিউ কমপ্লেক্সে যাই। পুরী এক্সপ্রেস ছাড়বে।

সুজন আর সতীশ নিউ কমপ্লেক্সের তেইশ নাম্বার প্ল্যাটফর্মে বসে। অপেক্ষা পুরী এক্সপ্রেসের। সুজন মাকে বলেছে, ফিরতে দেরি হবে।

সতীশ বলল, আমি কোনোদিন বেড়ালাম না কেন রে?

সুজন বলল, তোমার ভাইদের দাঁড় করাতে করাতেই তো তোমার জীবনের প্রথম দিকটা গেল। তারপর বেশি বয়সে বিয়ে করলে। আমি এলাম। কখন সময় পেলে বলো?

সতীশ বলল, পেলাম না। এটা বলে সতীশ হাসল, বড় করে হাসল, বলল, কিন্তু আমার তাতে কোনো খেদ নেই।

সুজনের চোখে জল এলো। বাবার চোখে কান্না, ক্ষোভ। মুখে হাসিটা মিথ্যা। আড়াল। একটা বাচ্চা রেললাইনে নেমে বোতল কুড়াচ্ছে। ও কোনোদিন জীবনে হয় তো পুরী যাবে না। সমুদ্র দেখবে না।

সতীশ উঠে গেল। বলল, আমি টয়লেটে যাব।

সুজন পয়সা দিয়ে বাইরে দাঁড়ালো। তার বাবা পুরী ছাড়া আর কোথাও যায়নি। কাকারা দাঁড়িয়ে গেছে। সবাই বাইরে থাকে। ব্যস্ত থাকে। আসার সময় হয় না। সেও তেমন কিছু যে একটা করে, তাও না। শুধু চায় বাবা আর মা একটু সুখে থাক। সারাটা জীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে তারা। এখন শরীর শোধ তুলছে তার।

সুজন.... বাবু....

বাবা দাঁড়িয়ে। বেল্টটা আটকাতে পারছে না। সুজন মাথাটা ঝুঁকিয়ে বেল্টটা আটকাচ্ছে। সতীশ তার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে।

সুজন মাথা তুলে দেখে সতীশের চোখে জল।

সুজন বলল, কি হল?

সতীশ ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমান করে বলল, তুই আমায় একবার দার্জিলিং নিয়ে যেতে বলেছিলি... তখন নাইনে পড়তিস... আমি পারিনি বাবু.. আমি অনেক কিছু পারিনি... আমাকে আর তোর মাকে ক্ষমা করে দিস বাবু....

সুজন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। কেউ কেউ তাকাচ্ছে। তাকাক। সুজন বাবাকে বাইরে নিয়ে বসালো। বাবার চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল গাল গড়িয়ে নামছে।

সুজন বাবাকে বলল, আমি তোমাদের বলিনি, আমি দার্জিলিং এর টিকিট কেটেছি আগামী মাসে। তুমি আমি আর মা। তোমায় সারপ্রাইজ দিতাম। কিন্তু তুমি এমন করলে না!

সতীশ হাঁ করে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে। বলল, সত্যিই...কিন্তু সে তো অনেক খরচ!

পুরী এক্সপ্রেস ছেড়ে গেল। সতীশকে নিয়ে ফিরছে সুজন। এতবড় শহর, কত কথা ওঠে পড়ে। কে কবে মনে রাখে! সুজন জানে বাবা খানিক বাদেই সব ভুলে যাবে। বাবা এখন শুধু অতীতে বাঁচে। বর্তমান ঝাপসা। পুরো ঝাপসা।

বছর গেল। সুজন একটা ট্রলি নিয়ে শিয়ালদা স্টেশানে। পদাতিক এক্সপ্রেস ধরবে। সে আর মা। বাবা মারা যাওয়ার আগে বলেছিলেন, তোর মাকে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে আসিস পাহাড়। নইলে আমার আত্মার শান্তি হবে না। আমার পারলৌকিক কাজ করবি না। সে টাকায় মাকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসিস। আমার আত্মা পিণ্ডিতে না, ওতেই শান্তি পাবে।

গঙ্গা পেরোবার সময়, সুজন মনে মনে গঙ্গাকে প্রণাম করে বলেছে, বাবা আমি তোমার নাভি ভাসিয়েছি এই গঙ্গায়, আমি তোমার কথা রেখেছি দেখো, দেখো মাকে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি গঙ্গা থেকেই দেখো।

পদাতিক এক্সপ্রেস এলো। সুজন মাকে সিটে বসিয়ে প্ল্যাটফর্মে নামল। বারবার মনে হচ্ছে বাবা সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। এক কাপ কফি আর একটা কেক কিনল। কফিতে চুমুক দিল। কফির স্বাদ নোনতা। সামনে সব ঝাপসা। বাবা ডাকছে, সামনে দাঁড়িয়ে ডাকছে, ট্রেনে ওঠ বাবু, সময় হয়ে গেল... আমি সিগান্যাল দিয়ে দিতে বলছি।