Skip to main content
 
 
       এই গরমে ভালো মেজাজ রাখা দায়। ভোলা সক্কাল সক্কাল উঠে পড়াশোনার মত করে বই নিয়ে বসেছে সদ্য, অমনি জানলার বাইরে সজনে গাছটায় একটা দাঁড়কাক অভদ্রের মত চীৎকার করতে শুরু করল। তাদের স্কুলের সংস্কৃত স্যার নিত্যরামবাবু'র গলার চাইতেও খারাপ। অসহ্য। ভোলা কিছুক্ষণ কাকটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কিছু একটা ফন্দী ভাবতে চেষ্টা করছে, বলরাম এসে জানলায় হঠাৎ ভূতের মত দাঁড়ালো। ওরা দু'জনেই টুয়েলভে পড়ে। বলরাম উত্তেজিত হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, "ওই ল্যাবা (ভোলার ভালো নাম)! সুজনদা'র দাদা আবার ক্ষেপেছে..."
       সুজনদা'র দাদার কথা শুনেই ভোলা ধাঁ করে চারদিক দেখে নিল একবার। না, মা-বাবা নেই এদিকে। তারপর চোখে একটা কৌতুক আর দুষ্টুমি মেশানো হাসি হেসে বলল, "কি করছে? আবার ওরকম?"
       বলরাম বলল, "তুই তাড়াতাড়ি আয় না রগড় দেখে তো হেসে বাঁচি না..."
       ভোলা বই তুলে টেবিলের উপর রেখে, গলাটা চড়িয়ে, "আমি এক্ষুনি আসছি", বলেই দৌড় লাগাল বলরামের পিছু পিছু। যদ্দূর মনে হল ভোলার মা কিছু শোনেনি, বা শুনলেও কিছু বলার উপায় নেই। সদ্য স্নান সেরে দীক্ষামন্ত্র জপতে শুরু করেছে। আর ভোলার বাবার এখন মাঝরাত প্রায়। তাদের নিজেদের খাটাল, সেইতেই আয়।
       ভোলা মাঝরাস্তাতেই বলরামকে ধরে ফেলল। তারপর দুই বন্ধু কোনো কথা না বলে হুড়মুড় করে দৌড়াতে লাগল। সুজনের বাড়ির সামনে প্রচুর ভিড় জমে গেছে। সুজন বাইরে মাঠে রোদের মধ্যেই উবু হয়ে বসে মাঠের ঘাস ছিঁড়ছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে কিছু বয়স্ক মানুষ কিছু বলছে। বোঝাচ্ছে কিছু মনে হল। সুজন 'হাঁ' বা 'না' কিছুই বলছে না। সুজনের মায়ের গলা এখান থেকে শোনা যাচ্ছে আর সুজনের দাদা বিজনের গলা। দু'জনেই দু'জনকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছে। অনেকেই মুখ টিপে টিপে হাসছে। চোখাচোখি করছে। ভোলা একে তাকে ঠেলে সদর দরজার কাছে গিয়ে দেখে বিজনদা আবার সেই একটা নাইটি পরে, ওড়নার মত করে গামছাটা নিয়ে, ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে, চুড়ি পরে, হাত ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে তুমুল ঝগড়া করছে।
       এর সূত্রপাত এবারের চড়কের মেলার পরেই। এবারেও বিজনদা তার মায়ের বেণারসি পরে পার্বতী সেজেছিল। প্রতি বছরই সাজে। সুজন বিজনের বাবা ছিল পাড়ার সেক্রেটারি, এই চড়কের। তাই তাদের পাঠ বাঁধাই থাকত ফি-বছর। কিন্তু সুজন একবার ছোটোবেলায় রাম সাজার পর আর ভালো লাগেনি বলে করেনি। এখন সে কলেজে পড়ে, সেকেণ্ড ইয়ার, কেমিস্ট্রিতে অনার্স। তার দাদা উচ্চমাধ্যমিক ফেল। ওর ছোটো থেকেই মেয়েলি স্বভাব। কম মার খায়নি মায়ের কাছে এই জন্যে। তার মা অনেক বুঝিয়েছে, "কপাল করে পুরুষ হয়ে জন্মেছিস... মেয়েমানুষের যে কি জ্বালা রে... যে মানুষের নিজের ইচ্ছা বলে কিছু নেই সে মানুষের জীবনের কি দাম বল? সে তো অন্যের ইচ্ছার কারাগারে জীবন কাটিয়ে দেয়..." কিন্তু কে শোনে কার কথা। বিজন নিজের নামটা পর্যন্ত বদলিয়ে বিজলি করতে চায়। হাইরোডের ধারে কয়েকটা বার আছে, সেখানে নাচতেও গেছে অনেকবার।
       বিজন মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে এখন। চীৎকার করছে আর বলছে, "হে ঠাকুর, এ কি জন্ম দিলে, আমার না একূল হল, না ওকূল।" তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলছে, "তুই মাগী কি বুঝবি এ জ্বালা... নিজে তো পুড়িসনি... আমি যে পুড়ে ছারখার হলাম রে মা..."
সুজন বিজনের মা, হঠাৎ থমকে গেল। যেন হঠাৎ কোথাও একটা ঠেক খেল কিছুতে। চারদিকে তাকিয়ে দেখল লোকে লোকারণ্য। বাচ্চা-বুড়ো-মাগী-মদ্দা সব 'হাঁ' করে তাকিয়ে... যেন যাত্রাপালা লেগেছে। বিষ নজরে চারদিকে তাকিয়ে একবার ঘরের ভিতরে গেল। তারপর কয়েকটা শাড়ি-সায়া-ব্লাউজ এনে উঠোনে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা বিজনের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, "যা বেরিয়ে যা ঘর থেকে, দূর হয়ে যা।" ঘরে ঢুকে দরজাটা ধড়াম করে ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল।
       উৎসাহী জনতার চোখেমুখে প্রথমে একটা বিহ্বলতা ফুটে উঠেছিল, কেউ কেউ 'আহা-উহু'ও করছিল, কিন্তু হঠাৎ পালাটা এমন শেষ হয়ে যাবে কেউ ভাবতে পারেনি। এই গ্রামে এমনিতেই পুকুরের জলের মত জীবনযাত্রা। স্রোত নিজের বলে কিছু নেই। খানিক ঝড়বাতাসে জলে যে দোলা লাগে সেইটুকু আমোদের একরত্তিও হাতছাড়া করতে চায় না গ্রামের কেউ। যেন কুকুর-বেড়ালগুলোও সতেজ হয়ে ওঠে। এমনিতে গ্রামে কোন্দলের অভাব নেই। তবে সে সব হঠাৎ হাওয়া। লোকে আজকের ঝড়টাকে রীতিমতো একটা কালবৈশাখী আশা করেছিল। তাই তার এমন আচমকা সমাপ্তি কারোরই মনে ধরল না। কেউ বলল, যাই রান্না চাপাই, কেউ বলল, শহরে কাজ আছে, কারোর ধান মাড়াই আছে... ইত্যাদি ইত্যাদি।
       মোটামুটি একটু ফাঁকা হলে সুজন উঠোনে এসে দাঁড়াল। বিজন তখনও উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে। ফোঁপাচ্ছে বোঝা গেল। শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। বলরাম আর ভোলা সুজনের ছাত্র। খুব ভালো বন্ধুত্ব তাদের নিজেদের মধ্যে। তারাও পিছনে পিছনে এসে দাঁড়াল। সুজন দেখল বিজন তার মায়ের একটা শাড়ি বুকের কাছে আঁকড়ে শুয়ে আছে। বলরাম একবার ভোলার চোখের দিকে কিছু একটা দুষ্টুমির ইঙ্গিতে তাকাতে গিয়ে দেখল, ওর চোখে জল। বলরাম সামলে নিল নিজেকে। সুজনদাদের বাড়ির পেয়ারা গাছটা দেখতে লাগল, বেশ কতগুলো ডাঁশা ডাঁশা পেয়ারা হয়েছে। জিভে জল চলে এলো যেন, নুন মাখিয়ে যা লাগবে না!
       সুজন বিজনের কাছে হাঁটু পেতে বসল। বলল, "দাদা ওঠ... আর পাগলামি করিস না।" সুজনের গলাটা একটু ধরা ধরা। সুজন তার মায়ের রাগের কারণটা বোঝে। তার মা বামুন পাড়ার মেয়ে। তার বাবার সাথে পালিয়ে বিয়ে করে। সেই থেকে তাদের মামাবাড়ি দশ কিলোমিটারের মধ্যে হলেও একদিনও যায়নি। তার মায়ের ইচ্ছা ছিল তার ছেলে মানুষ করে দেখিয়ে দেবে যে চাষার ঘরেও ছেলেমেয়ে মানুষ হয়। কিন্তু হল কই? সুজন আগে ভাবত চিকিৎসা করালে দাদা ঠিক হয়ে যাবে। এখন বোঝে এ ঠিক হওয়ার নয়। পাড়ার অনেক বিবাহিত পুরুষের সাথেও দাদার খারাপ সম্পর্ক, সব জানে সে। কিন্তু কি করবে? ফেলে দিতে তো পারে না? বাবা বেঁচে থাকলে কিছু একটা ভাবত হয়ত, সে ভাবতেও পারে না আর।
       ভোলা চমকে উঠল হঠাৎ পিঠে কারোর হাতের ছোঁয়ায়। মা! চোখের ইশারায় বাড়ি যেতে বলল। সুজনদাও বলল, "তোরা বাড়ি যা।" সারা রাস্তা ভোলা চুপচাপ এলো। তার মায়ের মুখটা গম্ভীর। বাড়ি এসে তার বাবাকে বলল, "কি যে করে হিজড়েটা, আমি আগেই বলেছিলাম বিনুদিকে, ওকে হিজড়েদের দলে দিয়ে দাও। তা না... লেখাপড়া শেখাবে... ন্যাকামি যত..."
       পাশের ঘরের কথাবার্তা চলছিল। ভোলা বাবার কোনো উত্তর শুনতে পেলো না। তবে পরেরবার চড়কে বিজনের আর পার্বতী সাজা হল না। সে বিষ খেয়েছিল। লোকে বলে তার মা-ই নাকি খাইয়েছিল। ভোলা বিশ্বাস করেনি।