Skip to main content

 

আমি ভালোবাসলেই যে আমার ভালোবাসার পাত্রটি একইভাবে আমাকেও ভালোবাসবে….. আমি সৎ বলে যে, যার প্রতি সৎ সেও আমার প্রতি সৎ থাকবে, এমন যে হয় না এই নিয়ে বহু আগেই মানব সভ্যতায় সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। “আমি চাই”, বললেই যে সেটা হয়ে যাবে না, পৃথিবীর আহ্নিকগতি, বার্ষিকগতির সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে মানুষ বুঝেই যায়। এ নিয়েও সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। অনেক কবিতা, নাটক, গল্প, উপন্যাস, দর্শন লেখাও হয়ে গেছে।

কিন্তু এ সব বাস্তবতা কি আমার আনন্দের খনিতে সিঁধ কেটেছে? আর চাইলেই তাকে কাটতে দেবোই বা কেন? সুখের ভাগ আমার কমাতে পারে, কিন্তু আনন্দের ভাগে হাত দিতে দেব কেন? সুখের সঙ্গে আমার ভাগ্যের বোঝাপড়া আছে, কিন্তু আমার বোধগম্যির সঙ্গে তো তার কোনো সম্পর্ক নেই। দুজন দুই পাড়ায় থাকে। সুখ আর ভাগ্য যে পাড়ায় থাকে, আমার বোধগম্যির সে পাড়ায় যাতায়াত থাকলেও বসবাস করার তো দরকার দেখি না। আর খামোখা বাড়ি ভাড়া করে সে পাড়ায় সে মরতে থাকতেও বা যাবে কেন?

আমার বোধগম্যির মধ্যে একটা আনন্দ আছে। সে চলকে চলকে পড়ে না। সে না-বিরক্ত হয়ে তাকায়। সে না-উদ্বিগ্ন হয়ে কথা শোনে। সে না-আবিল হয়ে আমাকে ছোঁয়। আনন্দের কোনো বিপরীত শব্দ হয় না। আনন্দের পরিধিতে কিছু শব্দ থাকতে পারে, যেমন সন্তোষ, ক্ষমা, ভালোবাসা। আদতে এরা কেউ নিজেরা আনন্দ নয়। কিন্তু আনন্দের ছায়ায় বাড়ে। আনন্দ ছাড়া এরা বাঁচে না।

তবে তাকে নিয়ে একটা মুশকিলও আছে। সে মুঠো শক্ত করলে কঁকিয়ে ওঠে। বলে, ছাড়ো। সে মুঠোতে আগলাতে গেলে বলে, ছাড়ো। বাঁধতে গেলে বলে, ছাড়ো। তার রাতদিন একটাই স্বর - ছাড়ো, ছাড়ো, ছাড়ো। ধরো খুব যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে ওকে বলতে গেলাম, দেখো, ও ভালো করল না আমার সঙ্গে। একি সুবিচার হল?

সে চুপ করে থাকে। ঠিক ভুল কিছুই বলে না। অনেক করে বলেও যখন কিছু হয় না, মনের মধ্যে যখন একে একে ক্ষোভ, অশান্তি ইত্যাদি এসে জোটে, সে ধীর স্বরে বলে, ছাড়ো, যা অশান্তির দিকে নিয়ে যায়, যা ক্ষুব্ধ করে, অন্ধ করে তোলে প্রতিস্পর্ধায়, তা ছাড়ো।

আমি যদি বলি, ছাড়ব না! না, না, না। আমার গায়ের জোর আছে। আমার যুক্তির জোর আছে। কিছুতেই ছাড়ব না। ওকে নাস্তানাবুদ করেই ছাড়ব।

সে আবার ধীর স্বরে বলে, তুমি কী চাইছ সেটা ঠিক করে দেখেছ কী? তুমি প্রতিশোধ চাইছ, না ন্যায় চাইছ? মনে রেখো দ্বিতীয়টার জন্য ধৈর্য লাগে। মহাভারত থেকে শুরু করে জগতের যত বড় বড় মহাকাব্য লেখা হয়েছে, সেখানে কী দেখেছ?

আমার ধৈর্য্যে পোষায় না। আমি অস্থির হয়ে বলি, তুমি বুঝছ না কেন, আমি বঞ্চিত, আমি অপমানিত, আমি লাঞ্ছিত হচ্ছি।

সে আবার বলে, তোমার এ বিচার ছাড়ো। শান্ত হয়ে দেখো, বেরিয়ে এসো।

আমি বলি, না।

সে বলে, আমি তবে যাই।

আমি বলি, যাও। তোমাকে চাই না আমার। আমার মান, আমার জেদ, আমার প্রতিস্পর্ধা অনেক অনেক বাস্তব তোমার চেয়েও। তুমি যাও।

সে যায়। আমি আমার সৈন্যদের নিয়ে রণক্ষেত্রে নামি। রণক্ষেত্রে নেমে দেখি আমার প্রতিপক্ষতেও আমিই। তবু জেদের বশে তরবারি চালাই। নিজেকে নিজে ক্ষতবিক্ষত করে শ্রান্ত, ক্লান্ত, গ্লানিময় চিত্তে ফিরে আসি। চারদিকে কেউ কোত্থাও নেই। আলো নেই, স্নিগ্ধ বাতাস নেই, তৃষ্ণার জল নেই। আমি একা। আমার সৈন্যেরা? কেউ নেই। কেউ ছিল না কোনোদিন। আমার কাণ্ডজ্ঞানহীনতার ছায়ায় ওদের তৈরি করেছিলাম আমিই। আমার অজ্ঞাতে।

দিন যায়। আমি আত্মবিস্মৃতিতে ডুবি। নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে অন্ধকারের মধ্যে হাতড়াই, কেউ আসুক। জানি কাকে চাই। কিন্তু আমার অভিমান তাকে ডাকার স্বরের উপর বসে। একদিন তাকে সরিয়ে দেওয়ার জোর জন্মায়। কানে সেই অমোঘ মন্ত্র বাজে - ছাড়ো। সেই মন্ত্রের জোরেই আমার অভিমান সরে যায়।

ছেড়ে দিই। অতীতের যে সব ঘটনাকে বিশালাকায় করে আমার স্নায়ুতন্ত্র আটকে রেখেছিল, তাকে ছেড়ে দিই। ছেড়ে দিতেই কী তুচ্ছ হয়ে যায় ওরা। আমারই রক্তে পুষেছিলাম ওদের এতদিন? কী আশ্চর্য! কী মূর্খামি!

শ্রান্ত শরীরে তার আসার শব্দ পাই। সে আসছে। আমার আনন্দ। আমার সত্তার গভীরে শিকড়ে শিকড়ে যার পুণ্য পীযুষ। সে আসছে। আমি কৃতাঞ্জলি হয়ে আনত। আমার হারে তার জয়। যে জয়ের সে তোয়াক্কা করে না কোনোদিন।