ভামিনী দুটো স্বপ্ন উনুনের আঁচের মত বুকে জ্বালিয়ে বেঁচেছে। একদিন ভাতের থালার উপর হাত দিয়ে বলবে, আর দিও না…. পারব না গো….. তাও কেউ তার সরু ফর্সা হাতটা সরিয়ে দেবে গরম ভাত তার থালায়…… আরেকটা স্বপ্ন… রান্নাঘরে সে ঢোকামাত্র কড়াই, হাতা, খুন্তি জেগে উঠবে। ঠং ঠং আওয়াজ হবে রান্নাঘর থেকে। সবাই বলবে, ভামিনী আছে গো রান্নাঘরে… ভামিনী।
ভামিনীর পঁয়ষট্টি বছর, চারমাস, তেরোদিনের শরীরটা নিথর। যমুনার ধারে। যেন শীতে কুঁকড়ে আছে। শীত তো শরীরের লাগে না। শরীরে যে থাকে লাগে তার। সে ছেড়ে গেছে ভোররাত্রে। শীতের করাত বাতাস এসে শরীরে লাগছে, যেন পাথরে লাগছে।
ভামিনীর একটা হাত জপের থলেতে ভরা, আরেকটা হাত যমুনার মাটিতে। চোখ দুটো খোলা। যেন খোলা জানলা। কিন্তু জানলা থাকলে কি হবে? ঘরে মানুষ কই? দরদে জাগে সত্য। ভামিনী সেই সত্যকে খুঁজেছে। ভামিনী খোলা চোখেই শুধু না, বন্ধ চোখেও মনের চোখ খুলে অপেক্ষা করত। তাকে নিতে না হয় না-ই এলো। দেখতে অন্তত আসুক।
কেউ আসেনি।
ভামিনী শেষ রাতে যমুনার তীরে শুয়ে শিয়ালদার ট্রেনের ঘোষণা শুনেছে। তার বাড়ি রাণাঘাটে নেমে যেতে হয়। কি করে যাবে এতটা রাস্তা, একা?
ভামিনী শুয়ে শুয়ে দেখছে বাঁকে বিহারি ভিড় গলি ছেড়ে আসছে। যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করেছে সে এতগুলো বছর, সেখানে বাঁকে বিহারি খুঁজতে এসেছে তাকে। নেই তো সেখানে সে। কতদিন হল ভালো করে দাঁড়াতে পারে না। যেখানে সেখানে পেচ্ছাপ হয়ে যায়। আটকাতে পারে না। এত মন্দির চারদিকে। যাবে কোথায়?
বাঁকে বিহারি আসছে। রিকশায় চেপে আসছে। দাঁড়ালো পরিক্রমা পথে। তার দিকে এগিয়ে আসছে বাঁকে বিহারি। মাথাটা ঝুঁকিয়ে বসে। জিজ্ঞাসা করছে, বেটি হাস্পাতালে চ…
ভামিনী বলল, মায়ের কাছে যাব।
বাঁকে বিহারি তার হাতটা ধরে নিধুবন দিয়ে হাঁটছে। মায়ের কাছে যাচ্ছি?
বিহারিজী হাসল। ভামিনী বলল, বলো না শ্যাম…. যাচ্ছি কোথায়?
বিহারিজীর মুখে হাসি। ভামিনী চলেছে।
সাধু ভামিনীর মাথাটা কোলে নিয়ে বসে। ভোরের রোদ এসে পড়েছে ভামিনীর মুখে। সাধু জিজ্ঞাসা করেছে, যাবি হাস্পাতালে? ভামিনী বলেছে, না।
একটু পর মিউনিসিপালিটির ভ্যান আসবে। অনেক ভামিনী এখানে ওখানে পড়ে আছে। তুলে নিয়ে যাবে। সৎকার হবে। শাস্ত্রমতে।
সাধু ভামিনীর মাথার উপর হাত রেখে বসে। গোটা সংসার সামনে বসে। সাধু সবাইকে জানাচ্ছে ভামিনীর চলে যাওয়ার কথা। যদি কারুর কাজে লাগে।
ভ্যান এসে গেছে। ভ্যানে আরো দুজন প্লাস্টিকে মোড়া শুয়ে। বাঁকে বিহারির চোখে জল। যমুনার জল। টলমল করছে। সাধুর কোল থেকে ভামিনীকে নিয়ে প্লাস্টিকে মুড়ছে। জপের থলেটা ছাড়ল না ভামিনী। সাধু ভামিনীর মাথায় হাত রেখে বলল, আয় মা…. আয়… সাবধানে যাস…… বাঁকে বিহারি ফিরে যাচ্ছে পরিক্রমা পথ দিয়ে…. সাধু উঠল। তাকেও তো যেতে হবে।