Skip to main content
 
 
দরজাটায় তালা দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন বিশ্বদীপ মল্লিক। কোমরটা টনটন করে উঠল। বাইরের লোহার গেটটা খুলে বেরোতে গিয়ে আবার ফিরে এলেন। দরজার সামনে ঝুঁকে তালাটা বাঁ হাতে চেপে ধরলেন। একটা হ্যাঁচকা টান দিলেন। ছেড়ে দিলেন। তালাটা একটা যান্ত্রিক আওয়াজ করে দুলে উঠল। তালাটার বয়েস তিরিশ বছর। মোটা কালো তালা। 
        বিশ্বদীপ মল্লিক আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। বাঁ হাতটার গোড়ার কাছটা ডান হাত দিয়ে চেপে ধরলেন। টাটাচ্ছে। তালাটা জোরে টানা হয়ে গেছে। বিশ্বদীপ মল্লিকের চশমায় বন্ধ দরজাটার প্রতিচ্ছ্ববি। দরজাটার বয়েস দেড়শো বছরের বেশি। বিশ্বদীপ মল্লিকের পৈতৃকবাড়ি। এখন ষোলোটা শরিক। বিশ্বদীপ মল্লিকের ভাগে দুটো শোয়ার ঘর। একফালি বারান্দা। একটা রান্নাঘর। বাথরুম পায়খানা কমোন। আর কুয়োটা। 
সোজা দাঁড়ালেন। ছোটো ছোটো পায়ে বড় রাস্তার দিকে এগোচ্ছেন। বড় রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে হাঁটছেন বিশ্বদীপ মল্লিক। সাদা পায়জামা আর সাদা পাঞ্জাবী গায়ে। রোগা শরীরটা সামনের দিকে ঝুঁকে এগোচ্ছে। বিকালের সূর্য তার একটা মস্ত ছায়া বানিয়ে রাস্তার পিচে ঢেলে দিয়েছে। তালাটা শক্ত হয়ে ঝুলছে দরজায়। দরজাটার কব্জাগুলোয় জং ধরেছে। 
        পার্কের বেঞ্চে একটা কোণ ঘেঁষে বসলেন। তালাটা বাবা কিনে এনেছিলেন না মঞ্জু? ছেলেটার সব কিছুই তো বাড়ির মধ্যে। যদিও সে নতুন ফ্ল্যাটে কানাডায়। বিশ্বদীপ মল্লিকের ছেলে বিপ্রতীপ মল্লিক। অনাবাসী ভারতীয়। স্ত্রী মঞ্জু মল্লিক মানসিক ভারসাম্যহীন। হোমে থাকেন। 
        বিশ্বদীপ মল্লিকের নিজেকে একটা সত্তর বছরের তালা মনে হয়। সব আগলে আছেন। মৃত্যুকেও। মঞ্জু মল্লিক মারা যাবে। বিশ্বদীপ মল্লিক কাঁদবেন। কেমন করে? বিশ্বদীপ মল্লিক অভ্যাস করেন। চোখে জল আনেন। মঞ্জুর মুখটা মনে করে। শোয়ানো, সাদা চাদরে ঢাকা। চশমাটা বিশ্বদীপ খুলে রাখছেন। মঞ্জুর বুকের ওপর তালা। হাল্কা লাগে বিশ্বদীপ মল্লিকের। 
        কে সে? কে তার? কেউ না। কা তব কান্তা..কস্তে পূত্রঃ...বিশ্বদীপ মল্লিক আকাশের দিকে তাকালেন। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। আকাশে একটা বিরাট বড় তালা। বিশ্বদীপ মল্লিক তালাটা খুলে এবার বাইরে যেতে চান। চাবিটা তার আছে। তালাটার ছিদ্রটা কোথায় জানেন না। সময় হয়নি এখনও। হলেই জানবেন।
        নিজের মৃত্যুকে দেখছেন বিশ্বদীপ মল্লিক। খাটে শোয়ানো। পাশে মঞ্জু। মঞ্জু লুডো খেলছে। তার বুকের ওপর দান চালছে। অনেক উপরে আকাশ। সেখানে আটকে প্লেন। প্লেনের জানলায় বিপ্রতীপ মল্লিক। তার একমাত্র ছেলে। নামতে পারছে না। বিশ্বদীপ মল্লিক মৃত হাতে চাবির গোছা আঁকড়ে। তালা ঝুলছে দরজায়। চাবিটা কাকে দেবেন? তালা মরে যায়, চাবি মরে না। ন হন্যতে হন্যমান শরীরে। মঞ্জু লাফিয়ে উঠল হাতে তালি দিয়ে - পুট পড়েছে পুট!
        বিশ্বদীপ মল্লিক ফিরছেন। হাঁটুটা টাটাচ্ছে। অনেকক্ষণ এক নাগাড়ে বসে থাকলে টাটায়। অন্ধকার হয়ে গেছে। রাস্তার আলোগুলো জ্বলে গেছে। বিশ্বদীপ মল্লিকের এই সময়টা মায়ের কথা মনে পড়ে। বুক পকেটে চাবিটা ছুঁয়ে দেখলেন। চাবিটার নীচেই হৃৎপিণ্ডটা। হৃৎপিণ্ড - আজব যন্ত্র, যেন যা হচ্ছে শর্টহ্যাণ্ডে লিখে যাচ্ছে সব কিছু। মস্তিষ্ক পরে বিচার করবে। লাইফ ইজ এ চয়েস - বিশ্বদীপ মল্লিক মনে মনে বললেন। না চয়েস না, লাইফ ইজ আ কি টু ওপেন দ্য রুম অফ সাফারিং..
        বিশ্বদীপ মল্লিক আকাশের দিকে তাকালেন। তারা দেখতে চেষ্টা করলেন। তারা লোডশেডিং না হলে দেখা যায় না। তারা একসাথে সবাই দেখে - তিনি, মঞ্জু আর বাবু। বিশ্বদীপ মল্লিক লোডশেডিং এর অপেক্ষা করেন হাঁটতে হাঁটতে।