ফরজানা আকাশের দিকে তাকিয়ে, মস্তবড় একখানা মাঠের মাঝখানে শুয়ে। চোখদুটো আকাশের দিকে খোলা। সকাল থেকে বুকে ব্যথা হচ্ছিল। স্কুলেও গিয়েছিল, ফিরে এসেছে। স্যারেরা বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাড়ি এসে বমি হল। মা বলল, সকালের নামাজে কিছু ভুলচুক করেছিস। বাবা বলল, আল্লাহ্র মেহেরবানিতে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ফরজানা এসে শুয়ে পড়ল বিছানায়। টালির উপর বৃষ্টি হচ্ছে। এখানে সেখানে জল পড়ছে চুঁইয়ে। অন্যদিন হলে ফরজানা বাটি, ঘটি যা পেত নিয়ে এসে পাতত। আজ পারছে না। পেটের মধ্যেটা কেমন করছে। বুকের মধ্যে চাপ চাপ ব্যথা। মাথাটা টলছে। বমি বমি পেয়েই যাচ্ছে। বাবা-মা ফারুক চাচার কাছে গেল। ফারুক চাচা গত বছর 'হজ' করে এসেছে। ফারুক চাচা একঘটি জলের মধ্যে কি সব ফিসফিস করে বলে, সেই জল যে-ই খায় সে-ই ভালো হয়ে যায়। এমনকি মড়া মানুষও বেঁচে ওঠে এমনও নাকি হয়েছে।
তাদের কুলাটি গ্রাম থেকে ফরজানাকে নিয়ে আরো তিনজন মাধ্যমিক দেবে এবার। ফরজানা জানে সে ফার্স্ট ডিভিসান পাবে। মানে পেতেই হবে আর কি। তার আব্বু ভ্যান চালায়, আম্মু বাজি বানায়।
ফরজানার মাথার উপর ফ্যানটা থেমে আছে। কারেন্টের তার কেটে দিয়ে গেছে। বিল জমা দিতে পারেনি এবার আব্বু। তার তিনটে ছোটোভাই। সবাই স্কুলে গেছে। ফরজানা উঠতে চাইছে, কিন্তু পেরে উঠছে না। মনে হচ্ছে এক্ষুণি অজ্ঞান হয়ে যাবে। চোখের সামনে মাঝে মাঝেই যেন কে একটা কালো পর্দা টেনে দিচ্ছে।
ফরজানার ঘাম হচ্ছে, বুকের ব্যথাটা বাড়ছে, শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে। শুয়ে থাকতে থাকতেই বমি হয়ে গেল। কোনো রকমে মাথাটা খাটের কোনের দিকে আনতে পেরেছিল, নইলে বিছানাটাই...
আব্বু ঢুকল, হাতে ঘটি। ফারুক চাচার কথা আল্লাহ্ শোনে। কিন্তু জলটা কয়েক ঢোক খেতেই হড়হড় করে বমি হয়ে গেল ফরজানার। জ্ঞান হারালো।
একটা ঝাঁকুনিতে মনে হল সে ভ্যানে। ফরজানাকে ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাদের ক্লাসরুমটা রাস্তার পাশেই, অশোক স্যার অঙ্ক করাচ্ছেন। ফরজানার মনে হল স্বপ্নে সে অশোক স্যারের গলা পাচ্ছে। বাইরেটা ঘোলাটে। সব ঘোলাটে লাগছে। কিচ্ছু স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না। ফরজানার বাবা-মা ভ্যানের পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে, মা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে আল্লাহ্র কাছে দোয়া করছে, ফরজানা যেন বুঝেও সাড়া দিতে পারছে না। বাঁ হাতটা প্রচণ্ড ব্যথা কাঁধের কাছ থেকে। শ্বাস আটকে আসছে।
ওঝা হুঙ্কার দিয়ে পড়ল ফরজানার উপর। ফরজানাকে ঘিরে বেশ কিছু লোকজন। দুপুর আড়াইটে বাজে। ফরজানার ভাইয়েরাও ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে, খিদে পেয়ে গেছে, কিন্তু আম্মুর কান্না দেখে কিছু বলতে পারছে না। ফরজানাকে জিনে ধরেছে, খুব খারাপ জিন। বদমাশ মেয়েমানুষের জিন।
ফরজানার মায়ের কান্না থেমে গেছে। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে দেখছে কি কি ঘটে যাচ্ছে। এখনই সে দেখতে পাবে জিনটা ফরজানার গলা থেকে বেরিয়ে সামনের ওই জামরুল গাছটায় গিয়ে বসবে, একটা ডাল ভেঙে পড়বে, মড়মড় করে। ওঝা সবাইকে জামরুল গাছটার নীচ থেকে সরে দাঁড়াতে বলল। ফরজানার বুকটা হাপরের মত উঠছে, পড়ছে। কে যেন বলল, ওকে হাস্পাতালে নিয়ে গেলে হয় না? অশোক মাষ্টার মশায়। ফরজানার উপর তার অদ্ভুত স্নেহ। রোগা মেয়েটা মাঝে মাঝেই বলে বুকে ব্যথা। কেউ গা করে না হাস্পাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য, অনেকবার কথাটা ফরজানার বাবাকে বলেছেন। উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি, মেয়েটার শ্বাস উঠেছে।
ফরজানা মারা গেল। ওঝা বলল, খুব খারাপ জিন ছিল, কলজেটাকে পুরো দু'ভাগ করে দিয়ে গেছে। ফরজানা এখন গ্রামের হেলথ সেন্টারের সামনে শুয়ে, ভ্যানে। ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট দেবে। ফরজানার আব্বু অপেক্ষা করছে বেঞ্চে বসে। একটু দূরে বৃষ্টির মধ্যেই ছেলেরা ফুটবল খেলছে। তার তিন ছেলে ভ্যানের চারপাশে বসে। এখন খিদে পাচ্ছে না কারোরই। কেউ কোনোদিন এর আগে গোরস্থানে যায়নি। এই প্রথম। কাল স্কুল ছুটি থাকবে --- অশোক স্যার এ'কথা বলে সাড়ে চারটের বাসে উঠেছেন। অশোক স্যার কাঁদছিলেন। বললেন, কুসংস্কার দেশটাকে শেষ করে দিল। ফরজানার বড় ভাই 'বিজ্ঞান ও কুসংস্কার' এর উপর রচনা লিখেছিল। রেহেমত স্যারের কাছে আর্টস পড়ে। রেহেমত স্যার বলেন, আল্লাহ্, গড, ঈশ্বর কিচ্ছু নেই। আব্বুকে সে কথাটা একবার বলেছিল ফরজানার বড় ভাই, আব্বু বলেছে, ওসব শুনতে নেই, গুনাহ্ হয়।
ফরজানার হাতের মুঠোয় একটা কালো কি ধরা, ওঝা ধরিয়েছিল। খুব শক্ত মুঠোটা। ফরজানার বড় ভাই খুলতে চেয়েও পারল না। এত ঠাণ্ডা মানুষের শরীর আগে ছোঁয়নি সে। ভ্যানের একটু দূরে রেহেমত স্যার দাঁড়িয়ে, ছাতা মাথায়, তাকে ইশারায় ডাকছে। ফরজানার বড় ভাই এগিয়ে গেল, রেহেমত স্যার পাঁচশো টাকা তার হাতে গুঁজে বলল, আব্বুরে দিয়ে দিস।
সে বৃষ্টির মধ্যেই চুপ করে টাকাটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর ধীরে ধীরে দিদির কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, "টাকাটা কি আব্বুকে দেব?"