কুহেলি ফুচকাটা মুখে দিয়ে রাস্তার দিকে তাকালো। ছেলেটা তাকিয়ে আছে।
কুহেলি ফুচকার স্বাদ পেল, নিল না। এভাবে নিজেকে একা একা ভালোবাসতে, নিজের খেয়াল রাখতে ইচ্ছা করে না। নিজের আবদার মিটিয়ে মিটিয়ে সময়ের জাল বুনে যাচ্ছে। গুটি কেটে বেরোবে কবে?
এবার জল ছাড়া দেবেন….
শুকনো ফুচকা। আলু মাখাটায় ঝাল আছে। চেনা মুখ। তাকাচ্ছে কেউ কেউ। কেউ কেউ হাসছে। কুহেলি এই নিয়ে ভাবে না। ভাবনাটা মিক্সি মেশিনের মত, যাই দেবে সেটারই ঘোল বানিয়ে ছাড়বে। অনেক কিছু নিয়েই আর ভাবে না। দুবেলা ভাতের জোগাড় হয়ে গেছে যখন বাকিটা নিয়ে আর ভেবে কি হবে? এই তো সামনের জুলাইতে একচল্লিশ ছোঁবে।
কুহেলি ফুচকার দাম মিটিয়ে বাসস্ট্যাণ্ডে এসে বসল। সিগারেট ধরালো। তার গালে অনেক বসন্তের দাগ। পারমিতা বলে তার গালদুটো নাকি সিগারেট খেয়ে খেয়ে পুরুষদের মত হয়ে গেছে। রুক্ষ। খড়খড়ে।
======
বাবার খাবার দাও… আমি নিয়ে যাচ্ছি।
কেন মেজদি যাচ্ছে তো…
না না আমায় দাও…. মেজদি বাবাকে খাইয়ে আসে না……
পাশের ঘর থেকে শব্দ এলো… ঢং।
বারো বছরের মেয়েটা, হাতে একটা ব্যাগ, ব্যাগের মধ্যে টিফিনবাক্সে ভাত আর তরকারি নিয়ে চলল। বাবা বালি তোলার কাজ করছে।
খেয়ে এয়েচিস মা?
না গো….
আমার সঙ্গে দুটো খা…..
না না… আমার লজ্জা লাগে… এত লোক…. আমি বরং মুড়ি বোঁদে খেয়ে নেব… পয়সা দিও….
নদীর ধারে বসে বাবা-মেয়ে। মেয়ে বাবার খাওয়া দেখছে। কি খাটে মানুষটা! তাকেই সব চাইতে বেশি ভালোবাসে। মেজদিকেও না, বড়দিকেও না অতটা।
জানো বাবা আমি না মেজদির গোবর চুরি করি…
কিভাবে রে?
আর মেজদি তো গরুর পোঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে… কে কখন হাগছে দৌড়াবে…. সে যেই দৌড় দেয় আমি এক খাবলা গোবর তুলে আমার ঝুড়িতে রেখে আবার খেলতে চলে যাই….
তাই তো মেজদি তোর সঙ্গে গোবর আনতে যেতে চায় না…শিব গায়েন হাসতে হাসতে বলল। প্রশ্রয়ের হাসি। এই প্রশ্রয়টুকু না পেলে বাঁচে কি করে মেয়েটা? এই প্রশ্রয় ফুলের পাপড়ির মত। আড়াল করে, সুন্দর করে।
আমার সঙ্গে যাবে না তো কে নিয়ে যাবে ওকে….. ভীতুর ডিম একটা…. আমরা সেই গোবরে ঢিল পুরে খেলি না…. সেটাও খেলবে না…. বলবে ছেলেদের সঙ্গে অত কি! আচ্ছা বাবা, ছেলেরা কি খারাপ?
শিব গায়েন নদীতে হাত ধুতে ধুতে হাসে। এই মেয়ে যদি একবার কথা বলতে শুরু করে….
না মা, ছেলেরা খারাপ কেন হবে… তবে বড় হচ্ছ বলে দিদি….
জানো মা-ও ধরে ফেলেছে…. সেদিন তো একা গেছি গোবর আনতে…. আমার তো খেলায় মন…. এইটুকু গোবর আনলেই তো মা মার দেবে…. তখন কি করেছি, দুটো ইঁট রেখে ঝুড়িতে তার উপর গোবর ফেলে এনেছি…
শিব গায়েন বিড়ি ধরাতে ধরাতে হেসে ফেলল… এ ঘটনা শুনেছে কাল রাতেই,
হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল মেয়ে। বলল, আমার ওই দুটো ইঁটেই মাথা ব্যথা হয়ে গেল। তোমার খুব লাগে না গো….
বলতে বলতে মেয়ের চোখ উপচে জল এলো….
শিব মেয়েকে তাড়াতাড়ি কোলে নিয়ে বলল, আজ আমরা একসঙ্গে বাজার করে বাড়ি যাব… বাবাদের মাথাটা ভগবান শক্ত করে বানিয়েছে… এই হাত দিয়ে দ্যাখ… দ্যাখ…. ইস কি নরম হাত… তাই তোর এত লেগেছে…..
=======
কুহেলি হাতের দিকে তাকালো। পিজবোর্ড এর মত খসখসে। ছেলেটার বয়েস কত হবে? তেইশ কি চব্বিশ। বড় বেশি কৌতুহল এখনকার ছেলেমেয়েদের। তাকে দেখতে চাইবে। আলো জ্বালা থাকবে ঘরে। জানলা দরজা বন্ধ। বাইরে দিনের আলো। নানা মানুষের কথা। গাড়ির আওয়াজ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে। হামলে চুমু খাবে। কামড়াকামড়ি করবে। যেমন দেখে ওইসব সাইটগুলোতে। ইন্টারনেটটাই এখন রেণ্ডিবাজার হয়েছে। বড় জ্বালায় এই বয়সের ছেলেগুলো। যতটা না খিদে, তার চাইতে বেশি কৌতুহল। এ কি কাস্টমার ছিল কখনও? কে জানে বাবা, মনে পড়ছে না।
বাসে উঠল। বসার জায়গা পেল। ছেলেটাও উঠল।
অস্বস্তি লাগছে। যে বন্ধঘরটা থেকে আজকে ছুটি নিয়েছে সেটার স্মৃতি আজকে ভালো লাগছে না। কি করবে, নেবে যাবে?
======
বাবা ঠাকুরের দশটা হাত কেন? ঠাকুর তোমার সঙ্গে বালি তুলতে এলে কত ভালো হত বলো?
শিব গায়েন মেয়েকে কোলে নিয়ে বলল, চুপ চুপ….
এক কালে জমিদার ছিল এরা। এ বাড়িতে এখনও অষ্টমী আর নবমী গরীব মানুষদের খাওয়ায়। শিব গায়েন মেয়েটাকে নিয়ে বসার অপেক্ষা করছে।
বাবা তুমি নতুন ধুতিটা পরে আসতে পারতে তো…
নতুন ধুতি পরে এলে মানুষের তাকানো বদলে যায় রে। বড় হলে বুঝবি।
=======
মানুষের তাকানো। কত যে তার মানে! গোটা জীবন কেটে যায় তার রকম বুঝতে। মানুষ শুধু নিজের তাকানোটা বুঝতে পারে না। আয়নায় যে তাকায়, সে কে?
লালবাবা কলেজ চলে গেল। দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো কুহেলি। নামবে এইবার।
ছেলেটাও নামল। তার থেকে কিছুটা দূরে দূরে হাঁটছে।
কুহেলি মায়ের মন্দিরে, ঠাকুরের মন্দিরে প্রণাম করে মন্দিরের পাশের মাঠে, ঘাসে এসে বসল। ছেলেটা আসুক। কত খারাপ কথা আর বলবে। ঠাকুর আছেন। বেলুড় মঠে তাকে যে প্রথম এনেছিল, সে ঠাকুরের কাছে এখন। বড় আগে চলে গেল। নাকটা টাটিয়ে উঠল। বড় দুঃখী মানুষটা ছিল। সোহাগ চাইত। কিন্তু দিতে পারত না। রোগে সে শক্তি গিয়েছিল। বিয়ে করেনি তাই। কুহেলিকে দেখে তার মনে হয়েছিল এ বুঝবে, করুণা করবে না। সংসারে কেউ তাকে ভরসা করেছে, এই কি কম!
কুহেলি কোনোদিন করুণা করেনি। ভালোবেসেছিল। এক একদিন মনে হয়েছে সে তো মা! তাকে কোলে শুইয়ে আদর করেছে। তার নগ্ন শরীরের সব লজ্জাকে হাতের স্পর্শ দিয়ে শুদ্ধ করেছে। লজ্জা নিয়ে বাঁচা ভীষণ লজ্জার।
একটু বসব?
আপনি কুহেলি তো…..
ছেলেটা বসল। একটু নার্ভাস। এরকম হয়। অনেক দেখেছে।
হ্যাঁ, বলুন।
বলছিলাম, একটা ইন্টারভিউ দেবেন… মানে সাক্ষাৎকার….
ইন্টারভিউ মানে আমি বুঝি…. কিন্তু কেন?
আমরা সমাজে সব স্তরের মানুষদের নিয়ে কাজ করছি। তাই এইবারে….
আর কাকে কাকে বলেছেন…..
আপাতত কাউকে না…. আপনাকে দিয়েই শুরু…. আপনার সাজেশান নিয়ে অন্যদের যোগাযোগ করব….
চা খাবেন?
হ্যাঁ, মানে, চলুন…
======
কুহেলির সাক্ষাৎকারটা ছাপা হয়নি। কেন হয়নি জানবার ইচ্ছা হয়েছে, কিন্তু জেনে ওঠা হয়নি। পত্রিকাটা কিনেছিল। বড় রগরগে গল্প সব। রমেশদা বলত, যোনিবৃত্তান্ত…. দালাল ছিল। বলত, কলকাতায় কিছু পণ্ডিত আছে তারা রাতদিন যোনিবৃত্তান্ত লেখে।
ছেলেটার সঙ্গে কয়েক বছর পর বইমেলায় দেখা হয়েছিল। কুহেলি চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। তখন সে ছেলে কই, লোক, পাশে সিঁদুর পরা মেয়েমানুষ ছিল না। তার বউ।
কুহেলি নিজেকে এই জায়গাটায় বোঝে না। এই মাথা নীচুটা কি লজ্জায়, নাকি ক্ষোভে, না অভিমানে?
======
বাবা, চিনতে পারছ?
শিব গায়েন সরকারি হাস্পাতালের বেডে শুয়ে। মেয়ে কলকাতায় এনেছে, চিকিৎসার জন্য।
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে।
উনি নেই আর…. আপনাকে বলা হল না….
আমি বিশ্বাস করি না….
তবে বিধান রায়কে ডাকতে হবে নাকি?
কুহেলি ওদের হাসি শুনেছিল। অনুভব হয়নি। কিছু না বলে চলে যাবে মানুষটা? বাবার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে কুহেলি। শেষ তিনদিনই বাবা তাকে চিনতে পারেনি। তাকিয়ে থাকত শুধু।
কুহেলিকে চেনার মানুষ সেইদিন থেকে নেই আর। বাবা-ই বুঝিয়ে গেলেন, আর তোকে কেউ চিনবে না রে টরটরি…. এই আমার চোখটা মনে রাখিস…. এইভাবে সব শূন্য হয়ে যাবে… তুইও….
======
কুহেলি বেলুড় মঠের মন্দিরের পাশে বসে আছে। অদৃশ্য ঠাকুর স্পষ্ট হয়ে বসে আছে তার পাশে। নইলে বুকে এত ভরসা জোগায় কিসে? ঠাকুর বলছেন, আমার উপর বিশ্বাস রাখ কুহেলি হারিয়ে যাবি না তবে….
কুহেলির চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। প্রার্থনায় বসবে এবার। প্রার্থনায় একটা শব্দ আছে "সমদরশন"... ওই চোখের কাছে সব সমান…. এমন দৃষ্টিও আছে, শ্রী শ্রী মায়ের মত এমন তাকানোও আছে…. নইলে সব কবে ছাই হয়ে যেত… মানুষ শুধু নষ্ট করে, রাখে তো ঠাকুর…..
কুহেলি সবার জন্য প্রার্থনা করে। প্রার্থনা যজ্ঞ। তার সব পাপতাপ মিলিয়ে যায়। ঠাকুর বলেন, পাপ কিরে কুহেলি…. আমার দিকে তাকা… তাকা…. দেখ সব ধুয়ে যাচ্ছে।
চোখের জলে ভাসে কুহেলি। সব ধুয়ে।