Skip to main content

সোনাইয়ের খুব ইচ্ছা সে ক্যাডবেরি বানাতে শেখে। আকাশে ছড়ানো সব জেমসগুলো কুড়িয়ে নিয়ে আসে পকেট ভরে। বড়দের খালি খালি কেন যে সব বাজে বাজে খাবার খাওয়ার ইচ্ছা হয়, সোনাই বুঝে উঠতে পারে না। বাবা কেন রোজ ফুচকা খায় না? মা কেন ক্যাডবেরি কি আইস্ক্রিম রোজ খায় না, বুঝে উঠতে পারে না। এখন তো রীতিমত বড় হতে ভয় করে সোনাইয়ের। অবশ্য বড় না হলে চাকরি করা যাবে না, আর চাকরি না করলে নিজের মত খাবে কি করে এটাসেটা?

সোনাই মোটা বলে বাড়িতে সবাই বকে। আত্মীয়রা এলেও বকে। সোনাই দেখেছে এতে বকার কিছু নেই। গরু, মোষ, হাতি এদের থেকে অনেক সরু সে। খাবার জন্য এত শর্ত তার মোটেও ভালো লাগে না।

বাড়িতে একা থাকলে কি কি খায়? প্রথমে চিনি। তারপর গুঁড়ো দুধ। বাবা, গুঁড়ো দুধ খুব সাবধানে খেতে হয়, নইলে ধক করে গলায় আটকে যায় কাদার মত। একবার না, দুবার হয়েছিল সোনাইয়ের। কোনো রকমে জল গিলে তবে বাঁচে। আর কি কি খায়? বিস্কুট, আর অল্প চানাচুর। আরেকটা জিনিস দারুণ লাগে, বিটনুন। কিন্তু খেলে যা গা গোলায়। তখন বিস্কুট খেয়ে কমাতে হয়।

লোকের বাড়ি বেড়াতে যেতে ওইজন্যে সোনাইয়ের এত ভালো লাগে। পেট খারাপ থাকলেও বলে না। চুপ চুপ গিয়ে খেয়ে চলে আসে। যখন সোনাই শোনে সামনে কোনো নেমন্তন্ন বাড়ি আসছে, ব্যস, আর তাকে পায় কে। দিন গোনা শুরু হয়ে যায়। সেদিন সকাল থেকে পড়া ভালো হয়, গান ভালো হয়, নাচ ভালো হয়। কারোর উপর রাগ হয় না। কি যে আনন্দ লাগে। সারাক্ষণ মনে হয় চারদিকে থইথই করছে লোক, সে একা একটা টেবিলে বসে খাচ্ছে। কেউ বলছে না, এটা খাবি না, ওটা খাবি না। কেউ বলছে না।

এতক্ষণ যা যা বললাম, এগুলো আগের সোনাইয়ের গল্প ছিল। এখন সোনাই অন্যরকম হয়েছে। কি করে হল সে গল্প বলব বলেই তো লেখা। সোনাইয়ের স্কুল খুলেছে। সবাই টিফিন নিয়ে যায়, সেও যায়। একদিন ম্যাগী, একদিন চাউ, একদিন স্যান্ডুইচ, একদিন সুজি, একদিল লুচি, একদিন ঘুগনি। এরকম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তো হল কি, সোনাই যখন অনলাইনে ক্লাস করত তখন সুজানা বলে একটা বন্ধু হয়েছিল। তাকে সে দেখেনি কোনোদিন। কিন্তু তাকে তার সব চাইতে ভালো লাগত। সুজানাকে দেখল এই যখন স্কুল খুলল। ও টিফিনে কি আনে বলো তো? বেশির ভাগ দিনই রুটি আর চিনি। এক একদিন বিস্কুট। খালি খালি বিস্কুট। ও টিফিন হলেই পেছনের বেঞ্চে চলে যায়, একটা বই নিয়ে যায়। বলে, আমার বিকেলে টিউশান পড়া আছে, ওখানে আমায় বকবে, তাই এখন পড়ব। প্রথম প্রথম সোনাইয়ের মনে হত ও সত্যি কথা বলছে। একদিন মনে হল, না, ও কিছু একটা বলছে না। সোনাই জানে সুজানার চোখটা অন্যরকম। মোবাইলের স্ক্রিনের মত। দুঃখ হলে, খুশি হলে বদলে বদলে যায়। অবশ্য তারও যায়, আয়নায় দাঁড়িয়ে দেখেছে। ঠাম্মি ঠাকুরের কাছে চলে যাওয়ার পর বাবা আর মায়ের চোখ দেখে মনে হত যেন বোলতা কামড়েছে ওদের চোখে। ঠাম্মিকে সে খুব ভালোবাসত। ঠাম্মি বিছানা ছেড়ে উঠতে পারত না। কিন্তু শুয়ে শুয়েই কত আদর করত। গল্প বলত।

তো সোনাই যখন বুঝে গেল আসলে সুজানা অন্য কারণে যাচ্ছে, তার কষ্ট হল। সে নিজের টিফিন ওকে দিতে গেলেও ও প্রথম প্রথম নিত না। একদিন মা টিফিনে ডিম পাঁউরুটি বানিয়ে দিয়েছে, সেদিন সুজানা নিল। এক কামড় মাত্র। বলল, ওর ডিম খুব প্রিয়। সোনাইয়ের ডিম খুব প্রিয় নয়, তবু ও ডিমকে প্রিয় করে নিল সুজানার জন্য। এখন সপ্তাহে দুদিন কি তিনদিনই ডিম আনে। মা বেশি করে দেয়। মা সুজানার কথা জানে। মা বলেছে, ওর বাবা নেই। করোনায় মারা গেছে। ও মামাবাড়ি থাকে। দাদু, দিদা, সুজানা আর ওর মা। সুজানার বাবা টোটো চালাতো।

সোনাই এখন খাবার নিয়ে আগের মত বায়না করে না। সুজানা ওর বেস্টফ্রেণ্ড। সে সুজানার মত হতে চায়। যাতে সুজানা তাকে দেখে লজ্জা না পায়। তারপর যখন তারা অনেক বড় হয়ে যাবে, নিজেরা চাকরি করবে, তখন তো সব খাবার খাবেই।

একদিন স্কুলে টিফিনে বসে বসে তারা খাচ্ছে আর গল্প করছে, হঠাৎ নবনীতা মিস এসে বলল, সুজানা তোমার বাড়ির লোক এসেছে। এসো।

সুজানা সেই যে গেল, আর এলো না। সোনাই রোজ ভাবত আজ আসবে। রোজ রোজ ডিম আনত, আবার বাড়ি নিয়ে যেত। মা অবশ্য বকত না। বলতো আসবে, মন খারাপ কোরো না। একদিন শুনল, ও আর আসবে না। ওর মা মারা গেছে। গলায় দড়ি দিয়ে। ও আর স্কুলে আসতে চাইছে না। মিসেরা সবাই নাকি যাবে ওকে বোঝাতে। ওর দিদাকে বোঝাতে। দাদুকে বোঝাতে। সোনাইয়ের খুব কষ্ট হল। একদিন ওর মাকে বলল, আমায় নিয়ে যাবে?

মা বলল, চলো।

সুজানা বারান্দায় বসেছিল। সোনাইকে দেখেই ঘরে ঢুকে গেল। মা ওর দাদু দিদার সঙ্গে কত গল্প করল। সোনাই অপেক্ষা করল। সুজানা এলোই না। ওর দাদু দিদা কাঁদলো কত। মা ডাকল সুজানাকে, ও তাও এলো না। সাড়াও দিল না।

সুজানা এলো। স্কুলে পড়তে না। স্কুলে কাজ করতে। ও আর পড়বে না। সোনাইয়ের খুব কষ্ট হল। কিন্তু কাকে বলবে? সুজানা তো তার সঙ্গে কথাই বলতে চায় না। এড়িয়ে এড়িয়ে চলে যায়। দিদিমণিরা বলে অনেকেই নাকি স্কুলে আর পড়তে চায় না। কাজ করতে চায়।

সোনাই চুপ করে থাকে স্কুলে। দূর থেকে দেখে সুজানাকে। সে জানে একদিন সুজানা তার পাশে এসে বসবেই। একদিন ও পড়াশোনা করবেই। একদিন দুজনে মিলে চাকরি করবেই। যা খুশি খাবেই। সব ঠিক আছে, শুধু টিফিন খেতে এখন আর আগের মত ভালো লাগে না সোনাইয়ের। যদিও জানে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।