বাড়ি ফিরে দাওয়ার উপর বউকে মরে পড়ে থাকতে দেখে আর বাড়িমুখো হয়নি চিকুন ভিখারি। এমনকি এই অবস্থায় বাড়ি ছেড়ে গেলে পুলিশে খোঁজ করতে পারে বলেও তার মনে হয়নি। স্রেফ মনে হয়েছে আর বাড়ি থেকে কি করবে, তাই রাস্তায় হাঁটা লাগিয়েছে। আঠারো বছরের দাম্পত্য জীবনে এক মুহূর্তে দাড়ি টেনে দিল।
অবশ্য পুলিশেও তেমন একটা খোঁজখবর করেনি। টগরকে দাহ করল পাড়ার লোকেই। কেউ শ্রাদ্ধশান্তি করল না। তবে দিন কয়েকের মধ্যে এ সে টগরকে তার বাড়ির সামনে দেখতে পাওয়ার পর, শিবমন্দিরে টগরের নামে পুজো দেওয়া হল। পাড়াগেঁয়ের ভূত বড় নাছোড়বান্দা। তা-ও ছাড়ে না। শেষে পাড়ার বিনোদ বাড়ুজ্জে সপরিবার কাশী যাচ্ছে শুনে পাড়ার লোক চাঁদা তুলে কাশীতে টগরের জন্য পিণ্ডি দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। সে পিণ্ডির ব্যবস্থা বিনোদ করেছিল কিনা জানি না, তবে টগরকে আর দেখা গেল না।
সমস্যা হল বলাইকে নিয়ে। বলাই পাড়ার এক বেকার, প্রায়ই এখানে ওখানে নেশার ঘোরে পড়ে থাকা এলেবেলে পাব্লিক। সে বলে বেড়াতে লাগল, সে নাকি টগরকে মাঝে মাঝেই দেখে উঠানে গান গেয়ে বেড়াতে। এখন টগরের জীবদ্দশায় কেউ টগরের গলায় গান শুনেছে বলে মনে করতে পারল না। টগরের গলায় ঝাঁঝ ছিল এ কথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করে। তাদের মাচায় হওয়া লাউ, বাগানে হওয়া সীম বা শাকপাতাতে কোনো পাখিও ঠোঁট বসানোর সাহস দেখাত না, মানুষ তো দূরের কথা। তো সেই টগরের গান বলাই শুনছে, এ বড় আশ্চর্যের কথা! প্রথম প্রথম লোকে আমল দিত না। মানুষ নেশা করলে অমন কত কি শোনে, দেখে --- এসব ভেবে হালকাভাবেই সব নিত। ঠাট্টাও করত কেউ কেউ। কিন্তু বেশিদিন হাল্কাভাবে নেওয়া গেল না। বলাই রাতদিন 'হাঁ' করে টগরের বাড়ির সামনে বসে থাকে। কেউ রাস্তা দিয়ে গেলেই তাকে ডেকে বলে, "এই... টগরকে বলো না আমাকে ওর সঙ্গে থাকতে দিতে। আমি ওদের দাওয়াতেই শুয়ে কাটিয়ে দেব।" সে কথাও প্রথম প্রথম লোকে পাগলের প্রলাপ বলে কাটিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু গোল বাধল যেদিন চাঁদু গড়াইয়ের মাথা কাটা দেহ পাওয়া গেল টগরের বাড়ির দাওয়াতে। চাঁদু গড়াই লোক ভালো না। কলকাতায় কি করে কেউ জানে না। টাকা-পয়সা আছে বিস্তর। স্বভাবচরিত্র ভালো না। পুলিশে বলাইকে তুলে নিয়ে গেল। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেল খুনের দিন রাত্রে বলাই নবদ্বীপ ছিল। গ্রামে ফেরে দু'দিন পর। তবে কে খুন করল? বলাই বলে বেড়াতে লাগল, টগর খুন করেছে। কারণ ওই 'হারামি চাঁদু' নাকি কলকাতা থেকে বাবু এনেছিল টগরের জমিটা বেচে দেবে বলে। এখানে নাকি সে চোলাইয়ের ব্যবসা করবে ঠিক করেছিল।
লোকে ভাবল হতেই পারে। একে তো টগরের বাড়িটা গ্রামের বাইরের দিকে। জঙ্গলে ঘেরা চারদিক। চোলাইয়ের ব্যবসা হতেই পারে। লোকের বিশ্বাস আরো দৃঢ় হল যখন রক্তমাখা একটা রাম দা পাওয়া গেল টগরের খাটের নীচ থেকে।
লোকে রাত হলে, বিশেষ করে অমাবস্যায় এই দিকটা এখন এড়িয়েই চলে। কি দরকার বাবা! চাঁদুর বাড়ির লোকজন নিজেরা টাকা খরচ করে চাঁদু আর টগরের একসাথে শ্রাদ্ধও করল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। টগর এখনও ওই ঘরেই আছে, বলাই বলে বেড়াতে লাগল।
এরপর মারা গেল যতীনের জেঠি। সেও ওই টগরের বাড়ির সামনে চোখ উল্টে কাপড়-চোপড় এলোমেলো অবস্থায় পড়েছিল। যতীন আবার পার্টি করে। পঞ্চায়েতের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ। যতীন বলল সে দেখে নেবে বলাইকে। টগরের জমি হাতানোর জন্যেই তার এই কারসাজি। কিন্তু যতীনও পারল না। যতীন নিরুদ্দেশ হল। কেন হল, কোথায় গেল কেউ জানে না। বলাই বলে বেড়াতে লাগল টগর গিলে খেয়েছে।
গ্রামে এখন লোকে টগরের বাড়ি আর বলাই - এই দুইকেই এড়িয়ে চলে। বলা যায় সমীহ করে চলে। বলাই এখন পাকাপাকিভাবে টগরের বাড়িতে থাকে। লাল কাপড় পরে। তিলক কাটে। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। এ বলাই যেন অন্য বলাই। সে বলে বেড়ায় টগর নাকি তার সাধনসঙ্গিনী। সুক্ষ্মদেহে তাদের সাধন। সেও লোকে বিশ্বাস করে নিল। এখন তো অমাবস্যায় রীতিমতো জনসমাগম হয় টগরের বাড়িতে। বলাই যজ্ঞ করে, হোম করে। আরো কত কি করে। লোকে বলে, যাক্..., ব্রাহ্মণের ছেলে সৎপথে ফিরে এসেছে। কথা মিথ্যা না। বলাইরা ব্রাহ্মণ। ভট্টাচার্য। তাদের অনেক শিষ্যশিষ্যাও আছে আশেপাশের গ্রামে।
বলাই এখন আশেপাশের গ্রামগুলোতে বেশ পরিচিত নাম। এমনকি থানার বড়বাবু প্রত্যেক অমাবস্যায় বিশেষ পুজো দেন নিজের পরিবারের নামে। অনেকের উপকারও হতে শুরু করেছে নাকি বলাইয়ের দেওয়া তাবিজে। সব তাবিজের উপর লেখা থাকে - 'ট'। 'ট' মানে টগরের নামের আদ্যাক্ষর। বলাই বলে, মন উচাটন হলে 'ট ট' জপ করতে। সব ঠিক হয়ে যাবে। বলাই টগরকে এখন ডাকে 'টগরেশ্বরী' বলে। ক্রমে টগরের বাড়ি হল টগরেশ্বরী মন্দির। আশেপাশে কত দোকান বসে গেল দেখতে দেখতে। যতীনও ফিরে এসে এখন বলাইয়ের সর্বক্ষণের চেলা হয়ে গেছে। সে সাদা ধুতি পরে খালি গায়ে থাকে। বলাই তাকে ডাকে যতু বলে।
বেশ ভালোই চলছিল সব। এর মধ্যে একদিন মন্দিরের সামনে ভীষণ হুজ্জুতি লেগে গেল। রাতে কে একজন নাকি খুন করতে গিয়েছিল বলাইকে। খুনী ধরা পড়েছে। লোকে প্রথম প্রথম চিনতে না পারলেও পরে চিনে গেল, আরে এতো চিকুন ভিখারি! সে নাকি গ্রামে ক'দিন আগেই এসেছে। তাকে কেউ খেয়াল করেনি। সে বলে বেড়াচ্ছে বলাইয়ের সঙ্গে নাকি তার বউয়ের আগে থেকেই ফষ্টিনষ্টি ছিল। সে জেনেও চুপ করে ছিল তার অশান্তি ভালো লাগে না বলে। কিন্তু তাই বলে সেই 'খচ্চর বলাই' তার বাড়িতে চড়াও হবে? তার মৃত স্ত্রী-কে সাধনসঙ্গিনী বানাবে? সুক্ষ্মদেহেও রমণ করবে?
গ্রামে হুলুস্থুল পড়ে গেল। যদিও সমাধান পেতে অসুবিধা হল না। ইতিমধ্যে ভক্তকূল চিকুনকে মেরে আধমরা করেই দিয়েছিল। যদিও আধমরা করার জন্য বিস্তর বলপ্রয়োগের দরকার হয়নি, যা স্বাস্থ্যের অবস্থা চিকুনের! পুলিশের বড়বাবু নিজে এলেন। পুরোনো ফাইল আবার খোলা হল। সাক্ষীও পাওয়া গেল, চিকুন বাঁশ দিয়ে নিজের বউকে পিটিয়ে মেরে পালিয়েছিল। পুলিশ চিকুনকে বেঁধে যখন গাড়িতে তুলছে তখন চিকুনের প্রায় জ্ঞানহীন অবস্থা। হঠাৎ সেই ভিড়ের মধ্যে বলাই এসে দাঁড়ালো। চিকুনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, এ পার্থিব জগত থেকে মন তোলো এবার চিকুন। এই বলে সে একটা 'ট' লেখা তাবিজ চিকুনের হাড় বেরোনো বাঁ-হাতের কব্জীতে বেঁধে দিল। চিকুন কোনোরকমে মাথাটা তুলে বলল, খানকির বাচ্চা শালা…
বলাই হেসে বলল, পাগল। ভক্তকূল বলাইয়ের পায়ে সাষ্টাঙ্গে লুটিয়ে বলল, আপনি মহাপুরুষ, আমাদের গ্রাম যেন নদীয়া হল, এ যেন আমরা জগাই-মাধাই উদ্ধার দেখলাম।
বলাই হেসে বলল, জয় মা টগরেশ্বরীর জয়।