Skip to main content

"শুবি না? এই শালা, এদিকে আয়, এই... আরে এই... কাঁথাটা ফেললি কেন?"

     একটা ঘর। কাঠের পাতলা পাটাতনের দেওয়াল। শীতের হাওয়া, বর্ষার জল, কিছুই বাধা মানে না। ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে রেললাইন। ট্রেনের কাঁপুনিতে দেওয়ালে ঝোলানো আয়নায় সারাঘরের দুলুনি দেখা যায়।

     শীতের সন্ধ্যে। দুটো কাঁথার তলায় শুয়ে তিন চারটে রাস্তার কুকুর। প্রমাণ সাইজের কুকুর। ষাটোর্ধ মানুষটা একটা লুঙ্গি কোমরের কাছে জড়িয়ে, হাঁটু অবধি তুলে, মেঝেতে মদের বোতল নিয়ে বসে। ঘরে টিমটিম করছে হলুদ ডুমের আলো।

     যাকে উদ্দেশ্য কথাগুলো বলা, সে একটা কালো ঘেয়ো কুকুর। বাইরে কুকুরের চীৎকার শুনে বেরিয়ে গেল। এরকম ভর সন্ধেবেলা বেরিয়ে যাওয়া একদম পছন্দ করে না লছমন। উঠে দাঁড়িয়ে দরজা অবধি এলো। কয়েকটা গালাগাল করল। কিন্তু শুনবে কে? আবার ঢুকে দরজাটা আটকে বিছানায় শোয়া কুকুরগুলোর গায়ের কাঁথা টেনে ঠিক করে মদের বোতল নিয়ে বসল।

     এদের ভাষা লছমন বোঝে। রিকশা নিয়ে দিনের বেলায় যখন এ পাড়া, সে পাড়া ঘোরে, মানুষের ভাষায় নিজের ভাষা খুঁজে পায় না। ধূর্ত আর বোকা মানুষ দেখতে দেখতে জীবনে বিতৃষ্ণা এসে গেছে তার। জীবনে না, মানুষে। মানুষ দেখলে গা গুলায়।

     সাদা কুকুরটা উঠল। পেসাব করবে। নিজেই মুখ ঠেকিয়ে দরজাটা খুলল। বাইরে গেল। আবার এসে বিছানায় বসল। তার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে। এ আসলে একটা ফেরেস্তা। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে লছমনের সব দুঃখ চলে যায়। ঘুমিয়ে পড়ে। ফেরেস্তা তার গাল চাটে। মাথায় নাক গুঁজে বলে, আমি আছি, তুমি শুয়ে পড়ো।

     যে কালো কুকুরটা বেরিয়ে গেল, এক নম্বরের হারামজাদা শালা। কারোর কথা শোনে না। খাওয়া নিয়ে ঝক্কি। মাংস না হলে খাবে না। লছমনের মনে হয় এদের সবাইকে সে পেটে ধরেছিল। তাদের মা সে। লছমন ওদের গায়ের পোকা বাছে। ওদের স্নান করায়। উৎসব পার্বনের দিন পেট ভরে খাওয়ায়, নিজে না খেয়েও। তবে ফেরেস্তা আলাদা, যতক্ষণ না রুটি লছমন নিজে খাচ্ছে, আর পরের রুটিটা ওকে খাওয়াচ্ছে ফেরেস্তা খাবেই না।

     লছমনের দিন চলেই যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন রেলের বড়বাবু এসে বলল, তার এ ঘর ভাঙা হবে। এটা রেলের জমি, এখান দিয়ে দার্জিলিং যাওয়ার ট্রেন যাবে। তাই লাইন পাততে হবে।

     কথাটা শুনে প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিল লছমন। তাই তো, এ তো রেলের জমি, ছাড়তে তো হবেই। কি করবে? রিকশা নিয়ে দুদিন বেরোলো না। ফেরেস্তা তার মুখের দিকে তাকিয়ে সারাটা সময় বসে থাকল। শেষে ওর জন্যেই আবার খাবার এনে দু’জনে খেলো। খেতে খেতেই হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল, তারা সবাই যদি দার্জিলিং এ চলে যায়? সেখানেই রিকশা চালাবে। শীতে তো কষ্ট হয় না তার। সোয়েটার ছাড়াই রিকশা টানে। রিকশা টানলে তো ঘাম হয়। শীতকাল তো বড়লোকদের। শ্রমের কাছে যমও হার মানে, তো শীত।


**** ***** ***** ******

 

     দার্জিলিং এর চিন্তাটা আচ্ছন্ন করে রাখতে শুরু করল লছমনকে। এই জায়গাটার উপর মায়াটা যেন হঠাৎ বেড়ে গেল। তার দাদা রেলে কাজ করত। সে-ই তো গ্রাম থেকে লছমনকে এনে এখানে একটা পান বিড়ির দোকান করে দিয়েছিল। ভালোই চলছিল সব। হঠাৎ দাদা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেল। বৌদি তার দুই মেয়েকে নিয়ে বিহারে ফিরে গেল। লছমন ফিরল না। বিয়ে করল। এখানেই একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে সংসার পাতল। বৌটার বাচ্চা পেটে জণ্ডিস হল। এত বাড়াবাড়ি হল যে বাঁচানোই গেল না। এক রাতে দুজনেই শেষ। বাচ্চাটা দেখলই না কোনোদিন লছমন। বৌটার পেটের মধ্যেই পুড়ে গেল বৌটার সঙ্গেই।

     তারপর লছমন কিছুদিন গিয়ে গ্রামে কাটালো। মন বসল না। এদিক ওদিক কাটিয়ে আবার ফিরল বাংলায়। রিকশা কিনল। দিনে দিনে মাতাল হল। একদিন ওই ফেরেস্তা, এইটুকু, কি করে তার রিকশার তলায় প্রায় চাপা পড়ে যাচ্ছিল। বাঁচালো তাকে লছমন। বাড়ি নিয়ে এলো। ব্যস, সেই থেকে ওরাই তার সব হয়ে গেল। একে একে আরো কুকুর এলো। লছমন ঘর বাঁধলো।

     এখন রাতদিন লছমন দার্জিলিং-এর কথা ভাবে। এখানে এক জায়গায় বিহারী অনেকে মিলে মঙ্গল, শনিবার রামনাম সঙ্কীর্তন করে। লছমনের মনে হল এখানে আর কদ্দিন আছে সে? একদিন না হয় সবার সঙ্গে সে একবার ভালো সম্পর্ক পাতিয়ে যাক। কিন্তু কেউ পাত্তা তো দিলোই না, দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। সে গেলে নাকি তাদের কুকুরের রোগ হবে। সে নোংরা। সে পাগল। লছমনের ফেরেস্তাকে জড়িয়ে কাঁদল। ফেরেস্তা তো কোনোদিন বলেনি সে পাগল, সে নোংরা?

     সবাই তাড়ালো লছমনকে। চায়ের দোকানে, মুদির দোকানে, লটারির দোকানে, মন্দিরে, মায় মদের ঠেকেও। সে নাকি রোগের ডিপো।

     লছমনের দাদার কথা মনে পড়ল, বৌয়ের কথা মনে পড়ল। কান্না পেল। কালো কুকুরটার ডান পা'টা রেলে কাটা পড়েছিল। কদিন কুকুরটা খুব কাঁদল। লছমনও কাঁদল। তারপর কুকুটার সব সয়ে গেল। এখন সে পায়ের কথা ভুলেই গেছে। বড় শোক মানুষ ভুলেই যায়। কিন্তু খালি পায়ে রেল লাইন ধরে হাঁটলে যেমন পায়ে পাথর বেঁধে, যন্ত্রণা দেয়, জীবনে তেমন ছোটো ছোটো অপমান, দুঃখগুলো বিঁধতেই থাকে, বিঁধতেই থাকে। ওরা সারে না, যায়ও না।

     হঠাৎ লকডাউন শুরু হল। লছমনের রিকশা নিয়ে বেরোনো বন্ধ। কদিন ক্লাবের ছেলেরা এসে চাল ডাল আলু দিয়ে গেল। তার জন্য না হয় দিল, কিন্তু কুকুরগুলো? লছমনের খাওয়া কমে গেল। একবেলা আধপেটা খেয়ে থাকল। ক্রমে ক্লাবের ছেলেরা ভুলে গেল। সেও আর মনে করালো না। কুকুরগুলো নিজের খাবার জোগাড় করে নিল। কিন্তু সে আর ফেরেস্তা রয়ে গেল অভুক্ত।

     লকডাউন চলছে। তাই লছমনের বাড়ির পাশের চায়ের দোকানটা খুলত না। লোকজনও আসত না। তাই বেশ কদিন পরেই লোকে টের পেল লছমনের ঘর থেকে পচা গন্ধ আসছে। পুলিশ এলো। দরজা খোলাই ছিল। দেখা গেল লছমন মরে পচে গলে আছে। একটা সাদা রুগ্ন কুকুর তার মাথার কাছে বসে আছে। লছমনের ঘর ঘেঁটে পাওয়া গেল কটা সোয়েটার। বাচ্চাদের। কিন্তু বাচ্চা কই? আসলে ওগুলো লছমন কুকুরগুলোর জন্যেই কিনেছিল, দার্জিলিং এ লাগবে তো। রিকশাটাকেও লকডাউনের কদিন আগে ভালো করে মেরামত করে এনেছিল, পাহাড়ি রাস্তায় চালাতে মজবুত রিকশা চাই না?

     লছমনকে নিয়ে যাওয়ার পর দু’দিন ফেরেস্তা লকডাউনের ফাঁকা রাস্তায় একা একা কেঁদে কেঁদে বেড়ালো। তারপর কোন এক ঝোপের মধ্যে মরে পড়ে রইল সে আর কে খোঁজ রাখে?

     এখন লছমনের ফাঁকা ঘরটা অন্ধকার পড়ে থাকে। কিছু কুকুর এসে শোয়। লছমনকে খোঁজে, ওর জন্য কাঁদে। তারা জানে না, এ ঘর ভাঙা হবে খুব তাড়াতাড়ি। এখান দিয়ে দার্জিলিং এর ট্রেন যাবে কদিন পর, যেখানে তাদেরও যাওয়ার কথা ছিল।