সৌরভ ভট্টাচার্য
13 February 2019
বয়েসের ছাপের থেকে একটা টানাপোড়েনের ছাপ বেশি সারা চোখেমুখে। প্রাইমারি স্কুলে পড়াতেন। উদ্বাস্তু কলোনি থেকে পড়াশোনা করেছিলেন। বাবা মারা গেছিলেন দাঙ্গায়। মায়ের খোঁজ পাননি এদেশে এসে। এর ওর দয়াদাক্ষিণ্যে পড়াশোনা। তার কয়েকদিন হাওড়া স্টেশানে কুলির কাজ। তারপর প্রাইমারি স্কুলে চাকরি।
বিয়ের পর সংসার গুছিয়ে বসতে বসতে চুলে পাক ধরল। অবশেষে একটা নিজেদের মাথা গোঁজার জায়গা হল। দুই ছেলে। একজন একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করে, আরেকজনের মোবাইল সারানোর দোকান।
আমার সাথে পরিচয় বড় ছেলের মেয়ের মাষ্টার হিসাবে। উনি নিতে আসতেন পড়া হয়ে গেলে। গল্প করতে ভালোবাসতেন, তাই পড়ার পর কিছুক্ষণ আমার সাথে কাটিয়ে বাড়ি ফিরতেন। এদিকে নাতনির পড়ার পাট চুকল, সাথে আমার কাছে আসারও, কিন্তু ঠাকুরদা মাঝে মধ্যেই এসে পড়তেন। কখনও কখনও সময় থাকত না, কখনও কখনও সময় থাকলেও ইচ্ছা থাকত না। উনি বুঝতেন, আবার বুঝতেনও না। নাকি বুঝেও উঠতে চাইতেন না, জানি না। গল্প হত বেশি ওনার বাংলাদেশের থেকে এদেশে আসার পর নানা উত্থানপতনের, লড়াইয়ের। রোগাটে মুখের গড়ন, বেশ লম্বা, গায়ের রঙ কালো। ধুতি পাঞ্জাবী পরতেন, পায়ে হাওয়াই চটি। পরিবারের অবস্থা খুব সচ্ছল না হলেও চলে যেত এমনই মনে হত।
সেদিন আমি বেশ ব্যস্ত। উনি এলেন। বসার ঘরে বসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বেরোবেন বুঝি?
বললাম, হ্যাঁ। সাতটা কুড়ি’র কল্যাণীটা ধরব, নৈহাটি যাব, নেমন্তন্ন আছে।
উনি নিজের দম দেওয়া বেশ পুরোনো হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললেন, তাহলে পনেরো মিনিট বসতেই পারি, কি বলেন?
কিছু বললাম না, হাসলাম। মুখেই, মনে কিছুটা বিরক্তি তো জমছেই।
বাড়ির সবাই পুরী যাচ্ছে বুঝলেন?
বললাম, বেশ তো ঘুরে আসুন না, ভালো লাগবে।
উনি ডান হাতটায় একটা ঝটকা মেরে আমার কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ধুর। বড়ছেলে টিকিট কেটেছিল তো, বললুম, যাব না।
আমি কিছুটা অন্যমনস্ক হয়েই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, কেন? শরীর খারাপ? মনে মনে একটা বড় গল্পের আঁচ পাচ্ছিলাম।
উনি কিছু বললেন না। আমাদের মধ্যিখানে রাখা টেবিলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মুখের ভাবটা এতটা বদলে গেল যে আমারও একটা অস্বস্তি লাগতে শুরু করল।
আসলে কি জানেন, এই ভিখারির জীবনটা কাটাতে কাটাতে, মানে ওই ক’টা টাকায় শূন্য থেকে শুরু তো… ওকে একটুও সময় দিতে পারিনি… ওর সখ-আহ্লাদ কিচ্ছু মেটাতে পারিনি… কিন্তু তাই নিয়ে একদিনও আমায় কথা শুনিয়েছে?
আমি ওনার মুখের দিকে তাকালাম সোজাসুজি… মাথাটা জোরে জোরে দু’পাশে নাড়ছেন… নাকের পাটা দুটো ফোলা… চোয়াল দুটো শক্ত…
জানেন ওর বোনের বাড়ি তো বড়লোক বেশ। একবার ওরা পুরী যাচ্ছে, তা দিদিকে, মানে ওকে বলল আমরা সবাই যেন ওদের সাথে যাই, খরচ সব ওদের… ও না বলে দিল… কেন জানেন?
এবার উনি ওনার ডান হাতের তর্জনীটা নিজের বুকের দিকে ফিরিয়ে ঝাঁকাচ্ছেন…, এই ভিখারির জন্য… এর ট্যাঁকে কিছু না থাক, আত্মসম্মানটা তো ষোলো আনা… তাই…
চুপ করে রইলেন। আমার ট্রেন ধরতে হলে এখনই উঠতে হবে। ওনার মুখের দিকে তাকালাম। চোখটা বন্ধ করে চেয়ারে এলিয়ে বসে। চোখের দুই কোনায় চিকচিক করছে জল। আমার ঘরের টিউবলাইটের আলোয় এমন চকমক করছে দেখে আমার চিল্কার কথা মনে হল। সকালবেলা চেন্নাই মেল থেকে যতবার দেখেছি ঠিক এমন। ঠোঁটটা কাঁপছে। ওনার স্ত্রী মারা গেছেন বহু বছর হল। ওনার রিট্যায়ার করার আগেই শুনেছি।
উঠে বসলেন সোজা হয়ে, ঘড়ির দিকে তাকালেন। অপরাধীর মত হাসলেন। হাতজোড় করে বললেন আমার জন্য…
আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম… তার আগেই ওনার শক্ত চোয়ালের বাঁধ ভাঙল। কেঁদে ফেললেন। ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন, একটাই শখ ছিল জানেন, পুরীতে গিয়ে জগন্নাথ দর্শন করবে, সমুদ্র স্নান করে ঝিনুক কুড়িয়ে নিয়ে আসবে। আমি পারিনি। আজ কোন লজ্জায় আমি এই শরীর নিয়ে জগন্নাথের সামনে দাঁড়াই বলুন… তাই হয়… বলুন না মাষ্টার… আপনি তো এত বই পড়েছেন… তাই হয়… আজ মানুষটা বেঁচে থাকলে তো কথাই ছিল না… কিন্তু কোন বুকে সেখানে দাঁড়াব… বুকটা ফালাফালা হয়ে যাবে না…
এর উত্তর মাষ্টারের জানা নেই। মাষ্টারের চোখ আর নাক টাটাচ্ছে। বললাম, ভালো করেছেন। চা বলি?
উনি উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন… আপনার ট্রেন…
বললাম, থাক, বসুন।