সৌরভ ভট্টাচার্য
1 August 2019
ঝপ ঝপ করে হলের আলোগুলো নিভিয়ে দরজার কাছে এসেই স্বপনের খটকা লাগল। বি সিরিজের আট নম্বর সিটে কেউ বসেছিল মনে হল?
বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। আরেকবার আলো জ্বালবে? সত্যিই যদি কেউ বসে থাকে? নাও তো থাকতে পারে! আচ্ছা এত ভাবনারই বা কি আছে, দরজাটা বন্ধ করে বাড়ি চলে গেলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়, এমনিতে সন্ধ্যে থেকে যা বৃষ্টি হচ্ছে।
সাইকেলটা টিকিট ঘরের পাশে পাঁচিলে ঠেসিয়ে রাখা থাকে। সিট কভার নেই ভাগ্যিস, নইলে ভিজে একেক্কারা হয়ে থাকত। স্বপন সাইকেলটা বার করে বড় গেটটায় তালা লাগিয়ে সাইকেলটার হ্যাণ্ডেল এক হাতে ধরে আরেক হাতে ছাতা নিয়ে চালাতে লাগল।
এই সময় দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যায়, তায় আজ ওয়েদার খারাপ। নাইট শো-তে একটা হিন্দি সিনেমা চলছে। তারই একটা গান গাইতে গাইতে সাইকেল চালাচ্ছে স্বপন। প্রায় উনিশ বছর হল সে এই সিনেমা হলের সাথে জড়িয়ে। তিন কূলে কেউ নেই। বিয়ে-থা করেনি। মেসে থাকে। সোজা বড় রাস্তা দিয়ে চালাতে চালাতে হঠাৎ বাঁদিকে একটা গলিতে ঢুকে গেল। একটা গুমটির সামনে এসে দাঁড়াল। এখানে দেশি মদের পাউচ বিক্রি করে রতন। সে অনেক পুরোনো খদ্দের। তা ছাড়াও রতন আর সে স্কুলের বন্ধু।
রতনের মেয়ে দরজা খুলল, বলল, "বাবা নেই। মায়ের সাথে ঝগড়া করে বিকালেই বেরিয়ে গেছে, আর ফেরেনি।"
স্বপন বলল, "তোর মা?"
"মা ঘুমাচ্ছে, মায়ের মাথাটা ধরেছে বলল। মা বলল, তোমায় বলে দিতে আজ মাল হবে না। মা টান মেরে সব চূর্ণীতে ফেলে দিয়ে এসেছে।"
স্বপনের মেজাজটা বিগড়ে গেল। আসলে এতক্ষণ সে নিজেও বোঝেনি সন্ধ্যে থেকে তার মেজাজটা এত ফুরফুরে হওয়ার কি কারণ হতে পারে। সে মালের স্বপ্ন দেখছিল তবে!
সাইকেলটা নিয়ে বড় রাস্তা পর্যন্ত হেঁটেই এল। ছাতাটা বন্ধ করে কেরিয়ারে আটকে নিয়েছে। প্যান্টটা ঢোলা আছে, বেল্টটাও ছিঁড়ে গেছে, কেনা হচ্ছে না, জামাটাতেও তেলের বিশ্রী গন্ধ। তার মেসের লাগোয়া একটা ঘানি আছে। সেই তেলের চিটচিট সারা ঘর। ধুর, বিরক্ত লেগে যায় জীবনের উপর। একবার ভাবল ওই পাড়ায় যায়, নয়নার সাথে... কিন্তু তারও যা দেমাক বেড়েছে আজকাল, তার উপরে রেটও বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়, খদ্দের হিসাবে স্বপনের দাম কমেছে। কারণ দুটো। এক, তার টাকা কম। দুই, তাকে সত্যিই দেখতে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই জ্বর হচ্ছে। দু-একজন বন্ধু বলেছে একবার এইডসটা টেস্ট করিয়ে নিতে। করায় নি। ঠিক ভয়ে নয়, নিজের উপর বিতৃষ্ণায়। কি হল তার সারাটা জীবন? এমন উপার্জন যে একটা পরিবার পালন করারও মুরোদ নেই!
স্বপন হঠাৎ খেয়াল করল সে সিনেমা হলের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। কখন এলো? কি করে এলো? সিনেমা হলটা একটা ভুতুড়ে বাড়ির মত, বিশাল জগদ্দল পাথরের মত দাঁড়িয়ে তার সামনে। হলটা ভীষণ পুরোনো। কিন্তু সে এখানে কেন? তবে কি কেউ টেনে আনল? সত্যিই কি কেউ আছে হলের মধ্যে! ভিজে চাপ-চাপ পুরো। বড় গেটের তালা খুলে ঢুকল। সাইকেলটা জায়গায় রেখে হলটা খুলল। ভিতরে এসে চারটে সুইচ পর পর অন্ করেই তার শিরদাঁড়া দিয়ে হিমেল স্রোত বয়ে গেল। একটা ফ্যানের সাথে ঝুলছে রতন, তার ছোটোবেলার বন্ধু।
স্বপন মাটিতে বসে পড়ল। প্রচণ্ড খিদে পাচ্ছে, বমি পাচ্ছে, মাথাটা ঘোরাচ্ছে। ব্যালকনির সামনের পাখায় রতন দুলছে, মাথাটা চক্কর কেটে গেল স্বপনের। কোনোরকমে উঠে দরজার কাছে আসতেই দরজাটা ধড়াম করে তার মুখের উপর বন্ধ হয়ে গেল। সাথে সাথেই হলের ভিতর থেকে একটা তীব্র আর্তনাদ। স্বপন কিছু ভাবার আগেই দৌড়ে হলের কাছে চলে এল, যেন কেউ টেনে আনল। রতন পাখাটায় নেই। দড়িটা ঝুলছে। রতন এ সিরিজের আট নম্বর সিটে বসে। তার দিকে তাকিয়ে। চোখদুটো টকটকে লাল।
বলল, "বোস, আয়।"
স্বপন কিছু ভাবতে পারছে না। যন্ত্রের মত তার পাশে গিয়ে বসে বলল, "আমি তো ভেবেছিলাম..."
"মরে গেছি... পিছনে তাকা..."
স্বপন হট্ করে পিছনে তাকিয়েই থ, রতন ঝুলছে।
সে তাকিয়েই বুঝতে পারছে রতন তার বাঁ হাতের উপর নিজের ঠাণ্ডা হিম হাতটা রেখেছে।
ফিসফিস করে তার কানের কাছে বলল, "ময়নাকে নিয়ে কেচ্ছাটা কেন করলি স্বপন?"
স্বপন চমকে তাকাল। ময়নাকে নিয়ে সে কিছু করেনি, ময়নাই তো তাকে...
স্বপন বলল, "আমি না... ওই তো..."
রতন বলল, "আমি যে সপ্তাহটা ভেলোরে চেক-আপে গেসলাম, তুই ময়নার সাথে রোজ রাতে লাফড়া করতে যেতিস না? আমার মেয়েটা কি গাঁজা মেরে শোয় **** রাতে?"
স্বপন গেছিল। আরো অনেকবার গেছিল। ময়না যেবার 'তার কাকির বাড়ি যাচ্ছি' বলে খড়দা গেছিল, আসলে সেবার তারা দীঘা গিয়েছিল।
রতনের চোখদুটো যেন ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসছে। স্থির তার দিকে তাকিয়ে। নিশ্বাস না নেওয়া মানুষ সে শোয়া অবস্থায় দেখেছে অনেক, কিন্তু বসে কথা বলা মানুষ...?!?
স্বপন বলল, "তোকে কে বলল?"
"*** ***** কে বলল?".... রতনের মুখ থেকে কয়েকটা গালাগাল বেরিয়ে এল, সাথে রক্ত, "এই দেখ।"
রতন পাশে রাখা একটা ব্যাগ থেকে ময়নার কাটা মাথাটা চুল ধরে বার করে বলল, "এই দেখ...."
স্বপনের চোখদুটো ধাঁ করে বন্ধ হয়ে গেল। এক্ষুনি জ্ঞান হারাবে মনে হচ্ছে। রতন ময়নার মাথাটা স্বপনের কোলের উপর রেখে বলল, "কর সোহাগ... শ্যালা... **** ****"
স্বপন সিটে সিঁটিয়ে বলল, "তবে যে মেয়েটা বলল...."
পিছন থেকে কে বলল, "বাবা শিখিয়ে দিয়েছিল।"
রতনের মেয়েটা দাঁড়িয়ে।
রতন বলল, "বিষ খাইয়ে মেরেচি... শ্যালা..."
পরের দিন হলের সামনে থিকথিক করছে ভিড়। একটা ঝুলন্ত বডি, একটা কাটা মেয়েমানুষের মাথা, আর হার্টফেল (সম্ভবত) করে মরা একজন হলের কর্মচারীর বডি --- মোট তিনটে বডি পাওয়া গেছে। পরে একটা বাচ্চার নিথর দেহ পাওয়া যায় রতনের বাড়ি থেকেই। পুলিশ তদন্তে নেমেছে।