Skip to main content


        বাঁ হাতটা পড়ে গেছে, স্মৃতি বলতে অফিসের ঘরটা, শেষ সই করা পেপারের শেষ লাইন ক’টা। জানলার ধারে একটা আরাম কেদারায় বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ফুলের কুঁড়ি ধরা, পতঙ্গদের খেলা, রঙবেরঙের ফুলের সমাহার, ফুলের ঝরে পড়া, শুকনো পাতার স্তূপাকারে জমে থাকা, গেট দিয়ে নানা মানুষের যাতায়াত যারা সবাই অপরিচিত এখন, কুকুর বেড়াল পাখিদের মত সচল জীব - সব চোখের মণির উপর ধারাবাহিক অর্থহীন প্রতিবিম্ব এখন। মল-মূত্র স্বেচ্ছায় শরীরের বাইরে আসে। হৃৎপিণ্ড, বৃক্ক, ফুসফুস, পাকস্থলী, যকৃৎ, অগ্নাশয় প্রত্যেকে সুস্থ, তৎপর। গায়ে ওষুধের গন্ধ। প্রতিদিনের পায়জামা ফতুয়া প্রতিদিন কাচা হয়। রিট্যায়ারমেন্টের আর বারো বছর ছিল। কমিশনার ছিলেন।

        ফোনটা এসেছিল শ্রীরামপুরের বাড়ির কাজের লোকের কাছ থেকেই। চেন্নাইতে তখন, অফিসের কাজে। স্ত্রীকে কুপিয়ে মেরেছে ছেলে। স্ত্রীর ঘুমের ঘোরে। ছেলের ড্রাগের নেশা। কাগজে বেরিয়েছিল যে মায়ের সাথে তার আগের দিন সন্ধ্যেতে টাকা-পয়সা সংক্রান্ত কিছু ঝামেলা হয়েছিল। খবরটা বড় করে ছেপেছিল। যে রাতের পোশাকটার ছবি দিয়েছিল ওটা সিঙ্গাপুর থেকে কেনা, ওর বড় ভাই এনে দিয়েছিল। উপুড় হয়ে মেঝেতে পড়েছিল। পাশে আসুফের ছবিও ছিল, তাদের ল্যাব, তার স্ত্রীর খুব নেওটা ছিল। ছবির নীচে জাপানী তেলের বিজ্ঞাপন ছিল। ছেলেটা ফেরার হল। পরে কলকাতার একটা লেকে পচাগলা দেহ পাওয়া যায়।
        ঘুমান না। সারারাত দেওয়ালের দিকে চোখ ফেরানো থাকে। অঞ্জলি ছ-বছর হল রাতের শিফটে কাজ করছে। এখন শাড়ি পালটাতে পাশের ঘরে যায় না আর। এত বছরে মাত্র একবার চোখের কোল থেকে সারাদিন জল পড়তে দেখেছিল, গত বছর জুলাই মাসে, সেদিন রথ ছিল অঞ্জলির মনে আছে। আর একবার খুব উত্তেজিত ছিলেন, সারাদিন মুখ থেকে অদ্ভুত আওয়াজ করছিলেন, হাত–পা ছোঁড়ার চেষ্টা করছিলেন। অঞ্জলি ভয় পেয়ে ওনাকে ওনার ঘরেই আটকে রেখে পাশের ঘরে শুয়ে ছিল। এমনকি হুইল চেয়ারটার পড়ে যাওয়ার আওয়াজ শুনেও এ ঘরে ঢোকার সাহস পায়নি। সেন্টারে ফোন করলেই কেউ এসে সামলে দিত, কিন্তু কথা শোনাতো, এইটুকু সামলাতে পারো না যখন ঘরে থেকে গেলেই পারো। এখন সব শান্ত। অঞ্জলি সেলাইয়ের কাজ ধরেছে। এই বাড়িতেই করে। সেন্টার থেকে আপত্তি করেছিল। শোনেনি। একটা বেড়াল আসে, যেই তার ডাকে একমাত্র এ বাড়িতে সাড়া দেয়। বেড়ালটা পোয়াতি। অঞ্জলি দুধ দেয় বাটি করে। খাক, অঞ্জলি সংসারে একা। বিয়ে হয়নি। সে কোনোদিন মা হতে পারবে না বলে। ছোটোবেলায় কি একটা রোগ হয়েছিল তার থেকেই নাকি এরকম হয়েছে। 
        মহালয়ার ভোরে ভদ্রলোক খুন হন। অঞ্জলি পাশের ঘরে ঘুমাচ্ছিল সেদিন। অনেক রাত অবধি সেলাই করেছিল। সামনে পূজো, অনেকগুলো অর্ডার। সারাদিন সেলাইয়ের সময় কই? সকালের শিফটে যে বাড়ি যেতে হয়, সেই বাড়ির বুড়োর পিছনে খাটতে খাটতে অঞ্জলির সারা শরীর বিষিয়ে যায়। ঘটনার রাতে সেলাই মেশিনের পাশে মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়ে অঞ্জলি। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন বিকাল থেকেই। ভোরে ওনাকে মুখ ধোয়াতে গিয়ে দেখে দরজা হাট করে খোলা, মেঝেতে লুটিয়ে আছেন, সাদা ফতুয়া রক্তে লাল, পাশে চাপ চাপ রক্ত জমে মেঝেতে। চোখ দুটো খোলা ছাদের দিকে। মুখে কোনো বিকার নেই। পুলিশ বলেছিল ছাদের দরজা ভেঙে ঢুকেছিল আততায়ী।

        খুনের কিনারা হয়নি। তবে কোনো প্রোমোটারের নাম ফেঁসে আছে। বাড়িটা বন্ধ পড়ে আছে আজ ছ বছরের উপর হল। বাগান বলে কোনোদিন কিছু ছিল না। এখন পুরো জঙ্গল। ফ্ল্যাট হবে কথা হচ্ছে। কিছু আইনি জটিলতায় কাজটা আটকে। নানা ভূতের গল্প বাড়িটা ঘিরে। কেউ বলে ওনার ছেলেকে দেখেছে একা মাঝরাতে উঠোনে পায়চারি করছে। কেউ বলে ওনার স্বামীকে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে কেউ। ওনার স্ত্রীর গলাও নাকি অনেকে পেয়েছে। অঞ্জলি রিষড়ায় একটা বাড়ীতে চব্বিশ ঘন্টার কাজের লোক এখন। পূজোর আগে একদিন এলো বাড়িটা দেখতে। গেটটা খুলে ঢুকল। চারদিকে এত জঙ্গল যে হাঁটার জায়গা নেই। বাড়ির পিছনের দিকে গিয়ে দেখল সিমেণ্টের বেঞ্চটা এখনও আছে কিনা। আছে। বসে থাকল চুপ করে। আজ তর্পণের দিন, তার নিজের বাবা মার তর্পণ করার সময় এই পরিবারের সবার তর্পণ করেছে। গোত্র জানত না, তবু মনে মনে বলেছে, সবাই শান্তি পাক। ব্যাগ খুলে একটা বোতল বার করল। গঙ্গা জল আছে। বাড়ির পিছনের দরজায় ঢালল। এদিকে কেউ আসে না। সামনের দিকে এসব করলে কে কি জিজ্ঞাসা করবে, তাই এইখানেই ঢালল। ভাঙা জানলার ভিতর দিয়ে ঘরের ভিতরটা দেখল। তার সেলাই মেশিনটা এখনও এখানেই। নেয়নি। নেবেও না। সবাই শান্তি পাক, এটাই কামনা। তার নিজের অগ্নাশয়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে। তার নিজের আয়ুও হাতে গোনা। মৃত্যুর পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে যেন। তার জন্য তর্পণ করার কেউ নেই। 
        অঞ্জলি দরজাটা লাগিয়ে রাস্তায় এসে একটা টোটোর জন্য অপেক্ষা করছে। সামনে পূজোর প্যাণ্ডেল বাঁধা হয়ে গেছে। এইটা তার শেষ দূর্গাপূজো, সে জানে। একটা সাদা বেড়াল ওই বাড়ির লোহার গেটটা থেকে বেরিয়ে, লেজ উঁচু করে তার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। অঞ্জলি চমকে নীচের দিকে তাকালো। খানিক থ হয়ে গিয়ে, নীচু হয়ে দুই হাতে বেড়ালটাকে কোলে তুলে নিল। অঞ্জলির চোখ ঝাপসা।