ভদ্রেশ্বর স্টেশানে বসে আছি। ভরা গ্রীষ্মের দুপুর। কুলকুল করে ঘামছি। চোখটা বন্ধ করে বাড়ির কুয়োতলার কথা ভাবছি, তার শীতল জলের কথা ভাবছি, হঠাৎ শুনি সুমিষ্ট গলায় একজন বলছেন, এ বছরের এপ্রিল মাসের তিন তারিখ যদি রবিবার হয়, তবে আশ্চে বছর এপ্রিল মাসের বারো তারিখ কি বার হবে?
তাকিয়ে দেখি এক রোগা টিংটিংএ মানুষ, ধুতি আর সাদা পাঞ্জাবি পরা, গলায় মোটা তুলসীমালা, বাইফোকাল চশমার ভিতর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি বললাম, মানে?
উনি আবার প্রশ্নটা বললেন।
আমি মোবাইলটা অন্ করে বললাম, দাঁড়ান বলছি।
উনি খপ্ করে আমার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে বললেন, উঁহু, উঁহু। হিসাব করে বলো… অঙ্ক কষো।
আমি ভাবলাম এ তো মহা জ্বালা হল! এই ভরদুপুরে স্টেশানে বসেও শান্তি নেই। অঙ্কে আমি বেজায় কাঁচা। জন্ম থেকে না, গত সব জন্ম থেকেই। নইলে এতটা কাঁচা কেউ হয় না। এই যে কিছু একটা কেউকেটা হলাম না, সে তো অঙ্ক পারি না বলেই। বেদান্ত দর্শনে মনটা কেন এসে জুড়ালো? কারণ সেখানে অখণ্ড ব্রহ্মের কথা আছে। কোনো খণ্ড বা খণ্ডাংশের হিসাব নেই। শেষে এই বাবাজীর কাছেও অপদস্থ হতে হবে! বেশ তাই না হয় হবে। আমি ওনার হাত থেকে আমার মোবাইলটা নিয়ে বললাম, আমি জানি না মশায়….
উনি বললেন, জানি না বললেই হল… কলেজে যাওনি?
গেছি।
পাস করোনি?
করেছি।
তবে? এই মাসের তিরিশ তারিখ যদি শনিবার হয়, অক্টোবরের চোদ্দো তারিখ কি বার হবে?
আমি বললাম, কি মস্করা হচ্ছে মশায়। বললাম তো জানি না।
উনি ব্যাগ থেকে একটা ক্যালেন্ডারের পাতা বার করলেন। সেখানে লাল লাল দাগ টানা। দু'দিকে দুটো করে সংখ্যা লেখা। কিছুই বুঝলাম না। উনি আমার নাকের কাছে কাগজটা ধরে, নিজের মাথাটা উঁচু করে, নিম্নদৃষ্টি হয়ে বলতে লাগলেন, এই মনে করো আজকের দিন হল আঠারোই এপ্রিল, সোমবার। এই দাগটা ধরে ধরে এগোও, এই দেখো, এই হল আগামী চারমাস পরে আঠারোই আগস্ট কি বার হবে? বিস্যুধবার। হল না?
উফ্ দাদা, কেন জ্বালাচ্ছেন বলুন তো! আমি এসব জানি না বললাম তো।
উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর ক্যালেন্ডার ব্যাগে ঢুকিয়ে বললেন, আমিও জানি না। আমার গুরুদেব জানতেন। উনিই এ কাগজটা আমায় দাগ কেটে বুঝিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সে রহস্য আমি আজও বুঝলাম না। তাছাড়া ধরুন, আমার জন্ম বাষট্টি সালের মে মাসের দশ তারিখ, তবে আজ আমার বয়েস কত বলুন তো?
বললাম, জানি না। রেগেই বললাম।
উনি বললেন, আমিও জানি না।
দু'জনেই চুপচাপ বসে। শেডের উপর কাক ডাকছে একটা। একটা বেড়াল চায়ের দোকানের সামনে ঝিমোচ্ছে। আমার ট্রেনের আরো দেরি আছে।
হঠাৎ একজন বেশ স্থূলকায়া, কৃষ্ণাঙ্গী বৈষ্ণবী কোত্থেকে উদয় হলেন। এসেই বললেন, হরে কৃষ্ণ, তুমি এখানে না… আমি ভাবি মানুষটা মুতবে বলে সেই যে গেলো… কত মোতে রে বাবা…. হরে কৃষ্ণ….
আমার বৈষ্ণবীর ভাষায় আর আচরণে ভিরমি খাওয়ার জোগাড়।
হঠাৎ বৈষ্ণব বললেন, এই দাদাও জানেন না…
বৈষ্ণবী বললেন, হরে কৃষ্ণ… তুমি তো শালা দেখসি কাউরে ছাড়বা না…. সে গুরুদেবের পোগাঢ়ো ভক্তিতে ঈশ্বরের দয়ায় ও জ্ঞান হয়েছিল… ও জ্ঞান যার তার হয়?
আমার ইগোতে লাগল। আমি যার তার?! যে সে! বললাম, দেখুন এ এমন কিছু কঠিন না… অনেকেই জানেন, এর একটা সূত্র আছে….
বৈষ্ণবী মুখটা বেঁকিয়ে বললেন, হরে কৃষ্ণ, সূত্র আছে না… উঁউউ আছে… চলো ওঠো…লস্যি খাই.. গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে….
বৈষ্ণব উঠল। উঁ মানেটা কি বুঝতে আমার বেগ পেতে হল না। বৈষ্ণব আমায় বলল, আবার দেখা যদি হয় গৌরের কৃপায় আমায় একটু শিখিয়ে দেবেন তো… নিজে শিখে নেবেন একটু কেমন…..
বৈষ্ণবী ততক্ষণে অনেকটা এগিয়ে গেছেন। বৈষ্ণবও হাঁটা লাগালো। আমি রাজ্যের অপমান, অপদস্থতা নিয়ে ঝিমিয়ে বসে। আচমকা আমার পাশে এসে বেড়ালটা ডাকল, মিঁউ।
যেন ব্যঙ্গ করল। বললাম, বেশ কর। তারপর ইউটিউবে সার্চ করে দেখলাম হিসাবের নিয়মটা। ততটা কঠিন না। গুরুদেবের মত পোগাঢ় ভক্তি ছাড়াই জানলাম। জানাব? পাগল? বৈষ্ণবী এরপর আরো কি কি বলে বসবে আমায় কোনো ঠিক আছে?
ট্রেন এলো। উঠলাম। একটার পর একটা স্টেশান যাচ্ছে। হঠাৎ শুনি চেনা গলায় কৃষ্ণনাম গান। হ্যাঁ, যা ভেবেছি তাই… সেই বৈষ্ণব বৈষ্ণবী। আমার সামনে এসে বৈষ্ণবী কৌটো ঝাঁকালো। আমি একটা দু'টাকার কয়েন দিলাম। বৈষ্ণব যাওয়ার আগে বলে গেল, আমি অপেক্ষায় থাকলাম দাদা….