বিন্দু পিছনে ফিরে তাকালে কাকে দেখে? কে ও? দুটো বিনুনি বেঁধে মাথায় বাবার পিছনে পিছনে ক্ষেতে যাচ্ছে, আলু তুলছে, মুলো তুলছে, পটল তুলছে… কে ও?
বিন্দুর বুকের উপর পাপের বোঝা। কিন্তু পাপ আর তার মধ্যে অল্প একটু ফাঁক আছে। তার ছেলেবেলার ফাঁক। পাপ ওইটুকু জায়গায় থাবা বসায় না।
আজ সকাল থেকে জ্বর জ্বর। ডাক্তার বলেছে, এ হবে। সারবে না। শরীরটা এই যে ভাঙছে, এও নাকি জুড়াবে না। সে বিন্দুও জানে আর জুড়াবে না।
সন্ধ্যে হল, বিন্দুকে না জানিয়ে। আগে বিন্দুকে জানিয়ে যখন সন্ধ্যা নামত তখন সামনের ফ্ল্যাটটা ছাড়িয়ে যাওয়ার সময় তাকে ডেকে বল তো, যাই রে। তখন বিন্দু সাজে মগ্ন। রাস্তার আলোগুলো একটা একটা জ্বলে যেতে যেতে বিন্দুকে জিজ্ঞাসা করত, বিন্দু সাজ হল….হল রে? বিন্দু আড়চোখে তাকিয়ে, সদর দরজার দিকে তাকিয়ে বল তো…সে কি এলো?
এই সে… কে?
বিন্দু সবাইকে মনে করতে পারে না। স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে। সুখ এসেছে। বিকার এসেছে। মরণ এসেছে টুকরো টুকরো। বিন্দু সাঁতরে সাঁতরে পেরিয়ে গেছে। নাকানিচুবানিও খেয়েছে।
এখন সে ভাঙা নৌকা। কিন্তু ভাঙা নৌকার হালে, পালে, বুকে জমা শ্বাস আটকানো জলে কি পূর্ণিমার চাঁদের ছায়া পড়ে না? পড়ে। পড়ে। পড়ে। সে চাঁদের আলো নিয়ে ভাঙা নৌকায় কি সুখের আলপনা আঁকা যায় না? যায় যায়। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে মরণাপন্ন মানুষ কী ভাবে খোঁজ নেয় কজন? যেন সে শুধু ওষুধে, স্যালাইনে, অক্সিজেনে বাঁচে…না না…। তারও স্বপ্ন আছে। কেউ খোঁজ নেয় না। সে নিজেও নেয় না। হাপরের মত ওঠাপড়া বুকে স্বপ্নের ভার যে ভীষণ, সেকি সে নিজেও জানে না?
আরতির ঘন্টা বাজছে। বিন্দুর বাড়ির থেকে কয়েকটা বাড়ি সরে গেলেই রাধাগোবিন্দ মন্দির। সেখানেই আরতি শুরু হল। তাকে তো যেতেই হবে। সেখানে যারা আসে তারা তার আত্মীয় সব। সোমনাথদা, যার চায়ের দোকান। বিশ্বজিৎ, খোঁড়া মানুষ, স্টেশানে লটারির টিকিট বিক্রি করে। তাছাড়া আরতিদি, পার্বতীদি, মল্লিকা, স্নেহা, জয়তী, মামণি…. এরা কেউ কেউ অন্যের বাড়িতে কাজ করে…কেউ দোকানে…..কেউ নিজের সংসার সামলায়। সেখানে বিন্দুকে কেউ আড়চোখে দেখে না। অল্প দূরত্ব রাখে। কিন্তু চোখ ফুঁড়ে, বুক ফুঁড়ে অপমানের গরম জল ছোঁড়ে না। বিন্দু ওইটুকু দূরত্বকে মাথায় করে রাখে। গোটা সমাজের সঙ্গে ওইটুকু ফাঁক তো থাকবেই। তার লাগাম ছাড়া সুখের দিনে কতটুকু ভাগ দিয়েছে সমাজকে? কিচ্ছু দেয়নি। সমাজ সেদিন রাতের অন্ধকারে রাস্তার কুকুরের মত তার বাড়ির পিছনের দরজার কাছে বসে থাকত। লেজ নাড়ত। বিন্দু দেয়নি কিছু। তাই আজ সে দিনের আলোয় সিংহের মত তার বাড়ির আশেপাশে গর্জন করে বেড়ায়। কিন্তু রাত হলে? হাসি পায় বিন্দুর।
কিন্তু নিজের অন্তর্যামীকে কোনোদিন অস্বীকার করেনি তো সে। ঈশ্বরের একমাত্র পুজো ঈশ্বরকে স্বীকার করা। যেমন সুখকে সুখে, দুঃখকে দুঃখে, অর্থকে অর্থে, ছলনাকে ছলনায়, তেমনই ঈশ্বরকে ঈশ্বরে স্বীকার করে নিতে হয়। সমাজে মানুষ ঈশ্বরের মধ্যে লোভ, সুখ, প্রতিশোধ দেখতে চায়। তাই ঈশ্বরকে একা পায় না। নিজেকেও না। নিজেকে না একা পেলে হয়? স্বার্থবুদ্ধিতে গোবিন্দকে দেখলে এক তরকারি নুনে পোড়া হয় মানুষের জীবন। গোবিন্দের দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে এটুকু তো বুঝেইছে বিন্দু।
আরতি শুরু হয়েছে। বিন্দু এসে দাঁড়ালো। দাঁড়াতে পারছে না সোজা। টলছে মাথা। নাট মন্দিরের একটা থাম ধরে দাঁড়িয়ে। বৃহস্পতিবার করে পাঠ হয় এখানে। চৈতন্যচরিতামৃত, ভাগবত। মাঝে মাঝে আসে বিন্দু। আজ মনে পড়ছে হরি ঠাকুরের কথা।
হরি ঠাকুর নাম জপ করত তিন লক্ষ। হরি সাধকের নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। নাম হবে আর শত্রু হবে না, তাই কি হয়? বেশ্যারও হয়, সাধকেরও হয়। তাই অমন মানুষেরও শত্রু হল। তারা পাঠাল এক খারাপ মেয়েছেলেকে হরি ঠাকুরের কুটিরে।
এ কথাটা যখন ব্যাখ্যা করছিল কথক, সবাই আড়চোখে তাকাচ্ছিল বিন্দুর মুখের দিকে। অনুশোচনা খুঁজছিল ওরা। পরিতাপ খুঁজছিল। দুর্বল মানুষ। লোভের তাড়নায় বুক জ্বলে, তবু মুখ ফুটে কিছু বলবে না সমাজের ভয়ে! আরে হতভাগা গোবিন্দ কি তোদের সমাজের মোড়ল? নাকি সে তোদের হৃদয়ের মণি?
হরি ঠাকুর নাকি সে মেয়েমানুষকে ফেরায়নি। বলেছিল নাম শেষ হলেই তার ইচ্ছা পূরণ করে দেবে। পুঁথিতে লেখে সে মাগীর নাকি মন ফিরে গিয়েছিল। সে নাকি সাধিকা হয়ে যায়। হরি ঠাকুর তাকে তার কুটির দিয়ে চলে যান। বিন্দু ভাবে, তাও কি হয়? মন ফেরে মানুষের? মন পুড়ে নিঃশেষ হয়। ফেরে কি?
পঞ্চপ্রদীপ নিয়ে এলো আরতিদি। তিনটে শিখা নিভে গেছে। খুব কম দিনই পাঁচটা শিখার আশীর্বাদ পায় সে। সবাইকে দিয়ে তার কাছে আসতে আসতে নিভে যায় যে! যেদিন খুব বৃষ্টি, যেদিন মন্দিরে লোক কম, সেদিন পাঁচটা শিখার আশীর্বাদ পায় বিন্দু।
বিন্দু ফিরবে। বড্ড তেষ্টা পাচ্ছে। বাড়ি যাবে। রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। পা টলছে। একটা টোটো পেলে ভালো হয়।
সামনে এসে দাঁড়ালো একটা টোটো। বলল, উঠে এসো।
বিন্দু উঠল। এ গলার আওয়াজ তার চেনা। কোনোদিন কোনো সন্ধ্যের অতিথি সে ছিল নিশ্চয়ই। নইলে তার বাড়ির দরজা চিনল কী করে? বলল, আমার হাতটা ধরো।
বিন্দু হাতটা ধরল। মাথাটা একটু ঠিক হয়েছে। পুরুষের ঘামের গন্ধ, শক্ত হাতের বেড়….হাতটা ছেড়ে দিল তার হাতের মধ্যে বিন্দু। তালশাঁসের শক্ত খোলার মধ্যে যেমন নরম সাদা তুলোর মত মিষ্টি স্বাদ জন্মায়, তার প্রাণে তেমন স্বাদ জন্মাতে চাইল আবার। বিন্দু তাকে বলল, তোমার যদি না তাড়া থাকে, তবে দরজাটা বন্ধ করে এসো।
বিন্দু একটা একটা করে আভরণ খুলে বিছানায় এসে শুলো। উপুড় হয়ে। যেটুকু চুল ছিল দিল খুলে পিঠের উপর। অপেক্ষা করতে লাগল ছোঁয়ার। তার বুকে, তার নিতম্বে।
হঠাৎ হ্যাঁচকা টানে চিৎ করে দিল তাকে। তার গলার উপর দেবে বসছে শক্ত দুটো হাত। তার মনে পড়ল এ ঘরে দামী কিছু আছে তো….সে সে না….গয়না, তার টাকাপয়সা…. বিন্দু তাও নিজেকে ছেড়ে দিল….ছেড়ে দেওয়াই এতকালের অভ্যাস তার….প্রাণপণে স্মরণ করল কাকে যেন….গোবিন্দ? নাকি অন্য কোনো পুরুষ… যাকে সে সবটুকু দিয়ে চেয়েছে….মরণের মত তার প্রাণে জেগে থেকেছে সে অহরহ…. কে সে? গোবিন্দের মুখে যেন তারই মুখের ছাপ…প্রশ্রয়… অবহেলা… অপমান…. ভালোবাসা….