১২৫টা সিঁড়ি ভেঙে ওঠার পর, মন্দিরে শিবের মাথায় জল দেওয়ার পর, যখন ভক্তি, শান্তি না এসে শুধু তেষ্টা আর খিদে চাগাড় দিল, সন্ধ্যা বুঝল, এই চুয়াত্তরটা বছর ভগবান তাকে শুধু ঠকিয়েইছে। সে-ও ঠকিয়েছে বিস্তর। ভগবান আর তার মধ্যে সারা জীবন শুধু লুকোচুরি খেলাই হয়েছে। স্বামীকে ঠকিয়েছে, ছেলে-মেয়েদের ঠকিয়েছে, আত্মীয়-স্বজনকে ঠকিয়েছে। আর নিজেকে তো ঠকিয়েছেই। তারাও ঠকিয়েছে তাকে।
বিয়ের আগে আর পরে নিজেকে যখন দেখে, নিজেকে মনে হয় হরিদ্বারের গঙ্গা, আর কলকাতার গঙ্গা। না, শুচিতা-অশুচিতার ধার ধারেনি সন্ধ্যা কোনোদিন। তার শরীরে প্রথম খাবলা বসিয়েছিল তার ঠাকুর্দার ভাই, জগন্নাথ ভট্টাচার্য। সে-ই যখন পুজো-আচ্চাকে জীবিকা করে আশি বছর জীবন কাটিয়ে সজ্ঞানে মারা গেল, সন্ধ্যার বিশ্বাস হয়েছিল যে শুচি-অশুচি মানুষের। সে শুধু মেয়েমানুষের মনে ভগবানের ভয়ের শিকল পরিয়ে পোষ্য বানাবার কল বই আর কিছু নয়।
কথাটা তা নয়। কথাটা হল বিয়ের আগে তার জীবন দিয়ে এত আবর্জনা বয়ে যেত না, বিয়ের ক'বছর যেতে না যেতেই যা শুরু হল। আবর্জনা মানে শরীর না। মনের অন্ধকার। সেই অন্ধকারে দেবতা থেকে শয়তান, কে না নেই। কে যে কার ছদ্মবেশে সে বুঝতে বুঝতেই এতগুলো বছর কেটে গেল সন্ধ্যার। তবু মনের ভিতরে নাক নিয়ে গেলে এখনও মায়ের আঁচলের গন্ধ। তেমন করে বুক হাতড়ালে প্রথম শরীর খারাপের ব্যথা। বাইরের মনটাই মরে যায়। ভিতরের মনটার নাক-মুখ চেপে ধরলেও মরে না। সন্ধ্যা আবিষ্কার করেছে মানুষের দুটো মন। একটা সমাজের বানানো। সেখানে আবর্জনার ঢাঁই। আর একটা জন্মের সময় নাড়ি থেকে জন্মানো, দগদগে আলোর মত জলজ্যান্ত মন। কারোর বানানো না। তাকে নিয়েই সমাজের ভয়। সে শরীর চেপে সব রসটুকু নিংড়ে চুষে খেলেও বলে, আমায় ছুঁতে পারলে কই? সেই মনটাকে ফাঁকি দিতে পারেনি সন্ধ্যা। সে মনও তাকে ফাঁকি দেয়নি। সে-ই আজ বলছে, তোর জলধরকে মনে আছে?
নাতি-নাতনীদের দিকে তাকালো। আইসক্রিম খাচ্ছে। ছেলে-বউরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ইতিউতি বসে। গল্প করছে। স্বামী নেই। আট বছর হল নেই। মরেছে।
জলধরকে মনে নেই? শালা শজারুর কাঁটার মত বুকে বিঁধে ছিল কত বছর। জলধর তার স্বামীর পিসির ছেলে ছিল। সেয়ানা। জলধরকেও ঠকিয়েছে। শরীর দিয়েছে। সুখ দিয়েছে। সুখ পেয়েছে। শান্তি দেয়নি। শান্তি চায়ওনি। সে কি ঘাটের মড়া নাকি যে রাতদিন 'শান্তি শান্তি' আওড়াবে? ওসব শ্রাদ্ধের মন্তরেই শুনতে ভালো… সংসারে ও সব আবার কি? দিনের সংসার আর রাতের সংসার কি এক? অভাবের সংসার আর প্রাচুর্যের সংসার কি এক? কেউ চুষে খাচ্ছে, কেউ ছিবড়ে চুষছে, কেউ কারোর গলায় হাত ঢুকিয়ে খাবার কাড়ছে... এখানে শান্তি!!
না, সন্ধ্যা নিজেকে এতটা বোকা ভাবে না। সে জলধরকে নাচিয়েছে। আগুনে পুড়বে সে শুধু একাই? জলধরের রাস্তায় ভাঙা ঝিনুকের টুকরো ছড়িয়ে রক্তাক্ত করেছে জলধরকে সে-ও। ভাঙা ঝিনুক, তার ভাঙা স্বপ্নের জ্বালা। অবশ্য নিজেও রক্তাক্ত হয়েছে।
জলধরকে মনে আছে। সে নিস্তেজ হয়ে মনের এক কোণে শুয়ে আছে। ফাঁকি দিয়েছে দু-দু'জনকে, এটা আজ না জানার কিছু নয়। দু'জনেই জানে। এটাই তো হয়!
"ঠাকুমা প্রসাদ দিচ্ছে, চলো…"
বড়ছেলে হরিপদ'র ছেলে, নিতাই। স্কুলে পড়ে। এর উপর যে কি মায়া! সন্ধ্যা অবাক হয়ে যায় নিজেকে দেখে। নিজেকে উজাড় করা ভালোবাসায় সে কোনোদিন বিশ্বাস করে না। কিন্তু নিতাইকে দেখলে সে বিহ্বল হয়। নিতাই মামাবাড়ি গেলে সন্ধ্যার খাওয়া কমে যায়। রাতে শুয়ে শুয়ে কাঁদে বালিশ ভিজিয়ে। সকালে উঠে দিন গোনে, এই তো আর ক'দিন… চলে আসবে… চলে আসবে…
সেই নিতাই ডেকে গেল। তার গায়ে কি এক সেন্টের গন্ধ। নিতাইয়ের সব ভালো লাগে সন্ধ্যার। সব সব সব।
প্রসাদ দেওয়া হচ্ছে। খিচুড়ি। মালসা করে। নিতাইয়ের পাশে বসল। বলল, তুই হাত দিস না, আমি খাইয়ে দিচ্ছি… আয় এদিকে….
নিতাই জলধরের নাতি। জলধর মনের মধ্যে উঠে বসল। বলল, ওর হাতটা ধুইয়ে দাও। নোংরা। সন্ধ্যা বলল। নিতাই হাতটা ধুয়ে এলো। সন্ধ্যা অল্প অল্প গরম খিচুড়ি মালসার পাশ থেকে নিয়ে, ফুঁ দিয়ে ঠাণ্ডা করে নিতাইয়ের মুখে তুলে দিচ্ছে। জলধর বলছে, আহা… দেখো আমার মত চোখের গড়ন না? দেখো নাকটাও আমার মত না? সন্ধ্যা বলল, না তো, আমার মত।
নিতাই খিচুড়ির দলাটা গিলে বলল, কি বললে?
সন্ধ্যা বলল, কই কিছু না তো... জল খাবি?
========
১২৫টা সিঁড়ি নেমে এলো। গাড়িতে উঠল। বড় গাড়ি। বড় ছেলেই কিনেছে। বনগাঁয় ভাড়া খাটায়।
শান্তি নামছে মনে। সন্ধ্যা চোখটা বন্ধ করে বসে। হাতে ধরা নিতাইয়ের হাত। জালের মত আঙুলগুলো একে অন্যকে জড়িয়ে। জলধর বলছে, আমায় একবার জড়াও… আমার কাছে এসো আরো… সন্ধ্যা… চোখ খুলো না…. এসো… এসো….
মা... ও মা…
চোখ খুলতেই সামনে একরাশ অন্ধকার। লোডশেডিং। বাড়ি চলে এসেছে। কোনটা আসল বাড়ি? মনের ভিতরে, না বাইরে?
সন্ধ্যা নামল। নিজের ঘরে গেল। স্বামীর ছবির সামনে প্রসাদী ফুল এগিয়ে বলল, নাও।
স্বামী নিল না। নেবে না। মানুষ কি নেয় আর কি ফিরিয়ে দেয় সমাজ জানে না। জানে দু'জন মানুষ শুধু। জীবন মানে তো শুধু দুটো জীবনের মধ্যে যা তাই। বাকিটা তো খেলা। চোর পুলিশ। আজ এ চোর, কাল সে। এই নিয়ে মানুষের কি গর্ব। আসলে ঢং। সং। সং-সার।
স্বামীর ছবির দিকে পিছন ঘুরে শুয়ে পড়ল সন্ধ্যা। আজ রাতে কিছু খাবে না। বুকের মধ্যে আঁচড় কাটছে জলধর। তাকে চাইছে। শান্তির জন্য না। ভোগের জন্য। এসো জলধর। এসো। সন্ধ্যার ঘুম জুড়ে নামছে স্বেদ। সুখের। সুখ মানে জ্বালা। জীবন। ঈশ্বর বলছে, নরক। তাপ। সব শেষ হলে শান্তি। ঈশ্বর বলছে, স্বর্গ। সেখানে মানুষ নেই। শুধু নিঃসঙ্গ ঈশ্বর।