ক্লান্তিতেই হবে, নইলে হঠাৎ করে বিদ্যাসাগর মশায় এসে ঘুমের মধ্যে ঢুকবেন কেন? যা হোক, ঢুকেই যখন পড়েছেন, সে ঘুমের মধ্যে হলেও, বসতে বলতে হয়। তা তিনি আমার কথা না শুনে সারা ঘরময় ঘুমের মধ্যেই পায়চারি শুরু করে দিলেন। আমি বললাম, ও মশায়, অমন হাঁটেন কেন, একটু বসেন না, দুটো কথা কই?
তা তিনি তো পাত্তাই দিলেন না। আমার দিকে একবার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে, গায়ের চাদরটা কাঁধে ফেলে বলতে লাগলেন, এও সম্ভব... এও সম্ভব…
এমনিতেই ক্লান্তির ঘুম। মাথাটা ঠিক কাজ করছে না। তার উপরে আকাশ উপচে পড়া বর্ষা। রাস্তাঘাটে জল জমছে, মোটে ভাল্লাগছে না। আর এদিকে উনি “এও সম্ভব... এও সম্ভব...” বলে পায়চারি করেই যাচ্ছেন... করেই যাচ্ছেন…
আমি আবার বললাম, ও মশায়, কি সম্ভব অসম্ভব বলচেন গো... আমি তো কিস্যু বুঝচি না…
উনি ফোঁস করে উঠে বললেন, আমি তোমাদের স্কুল-কলেজ ঘুরে দেখলুম, তোমরা তো মাতৃভাষাটা ভুলেই গেছো দেখছি... তার উপরে ভর্তির ফর্মে, চাকরির ফর্মে কিসব লেখা এসসি, এসটি, ওবিসি... তোমরা আবার নতুন করে জাতপাত খুলেছ নাকি হে?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, অ এই কতা...! দাঁড়ান... আপনি গ্রীণ টি খান? আমিও একটু খাই... এই ক্লান্তি জড়ানো ঘুমে স্বপ্নগুলো হেজিয়ে যায়... যুক্তিগুলান পিছলে যায়... এট্টু চা খেয়ে কতা বললে হয় না?...
বাহ... বাহ... কি ভাষাজ্ঞান...! হেজিয়ে যায়... বাহ্... কোনো সবুজ হলুদ চা খেতে হবে না... ঘুমের চোখেই সত্যি কথাগুলো বেরোবে... চা খেয়ে যুক্তি সাজালেই যত রাজ্যের মিথ্যার প্যাঁচাল পাড়বে... তা শুনি কি বলার আছে... এগুনো কি হ্যাঁ…?
আমি স্বপ্নের মধ্যেই একটু গলাটা খাঁকারি দিয়ে বললাম, আসলে বুঝলেন তো ইংরাজি ভাষা না শিগলে আজকাল কেউ পোঁছে না... মানে চাগরি-টাগরি হয় না... আপনাদের সময় দেশে যত না সাহেব ছিল মশায়, এখন দেশের অলিতে গলিতে সাহেব। তারা মাতৃভাষাকে ম্লেচ্ছভাষা জ্ঞান করে... তাই আর কি…
বুঝলাম। আর ওই ফর্মের মধ্যে ওসব কি প্রতীকি শব্দ...? এসসি, এসটি, ওবিসি... ওগুলো কি? নতুন জাতের নাম?...
আজ্ঞে না। সংরক্ষণ। মানে পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য সংরক্ষণ।
ওতে কি হয়?
ওতে মেধার ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়…
সেটা কিরকম?
মানে আপনার ক্ষেত্রে সরকার বাহাদুর মার্ক্স কম হলেও মেনে নেবেন…
কিন্তু এতো অপমান?
ইয়ে মানে কাকে অপমান?
মানে যাকে নাম্বার কম হলেও মাথা কাত করে ‘আচ্ছা’ বলা হল তাকে?
কেন মশায়?
কেন নয়? ওদের জন্য কি আলাদা প্রশ্নপত্র হয়?
না।
আলাদা প্রশ্ন হয় না? এদিকে আলাদা যোগ্যতার বিচার হয়?
হয়। তা দেখুন, ভারতে অনেক জায়গা আছে যারা স্কুলে যেতে পারে না, ভালো জায়গায় পড়তে সুযোগ পায় না, তারা কি করে যারা প্রিভিলেজড তাদের সঙ্গে একই প্রতিযোগিতায় আসবে বলুন…?
কিছুই বুঝলাম না হে... বলি ধরো একজন শিক্ষকতা করবে। তা তার জন্য একটা নির্দিষ্ট যোগ্যতা তো থাকা দরকার? তো সে ক্ষেত্রে একজনকে কম যোগ্যতায় আনা মানে হয় আগের যোগ্যতার মাপকাঠিটা ঠিক ছিল না, নয় আদতে কোনো যোগ্যতার মাপকাঠিই হয় না... অথবা আসলে সবটাই যা খুশি একটা আর কি…
তা নয়, আপনি যেমনভাবে পড়াশোনা করেছেন, সবার কি অমন ধৈর্য্য অধ্যবসায় থাকে বলুন? থাকে না তো।
কিন্তু সে তো না হয় বুঝলাম। তা বলে ওদের অপমান করার অধিকার কে দিল তোমাদের? যে মানুষটার সত্যিকারের যোগ্যতা আছে, মানে মেধার মান আছে, তাকেও তবে তোমরা মুড়ি-মিছরি এক করে ফেলবে?... সবাই ভাববে ও এই টাইটেল... মানেই তো কম মেধায় উতরে গেছে... বলি এ কিরকম যুক্তি তোমাদের? তা যারা পড়তে পারে না, স্কুলে যেতে পারে না, তাদের সে সবের ব্যবস্থা কেন ফ্রি করে না তোমাদের সরকার বাহাদুর? এদিকে তো শুনি কোথায় যেন কম টাকায় চাল-ডালের ব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে করে যাচ্ছে? একি রকম অদ্ভুত ব্যবহার তোমাদের? মেধা নিয়ে কম্প্রোমাইজ কেউ করে?
এটা ঠিক কম্প্রোমাইজ না স্যার... এটা হল আসলে আমাদের ডিল। এই ডিলেই তো এত বছর কেটে গেল।
ন্যায্য কাজ হচ্ছে? মানে যারা সত্যিই বঞ্চিত তারাই কি শুধু পাচ্ছে এই গোলমেলে অবস্থার সুযোগ খালি? নেপোয় মারে দই হয়ে যাচ্ছে না? মানে যাদের দরকার নেই তারাও কি…
থাক থাক মশায়। সে সব ক্ষেত্রেই তো হয়। ভালো কাজে একটা নিয়ম করা হল সেটা তো কিছু মানুষ সুযোগ নেবেই। মন্দির করা হলে মূর্তিচোর তো আসবেই।
বাজে যুক্তি। মেধার সঙ্গে এরকম খেলা চলে না। এ তাকে অপমান করা। তাকে বলা যে তুমি পিছিয়ে পড়া বলেই তোমার মেধাও পিছিয়ে পড়া। তোমার পিছিয়ে পড়া মেধাকে আমরা তবু ছাড় দেব। এই তবু কথাটার মানে কি? মানে তাকে মেধার দিক থেকে পঙ্গু করে দেখা না? একি অসভ্যতা। এ করুণা করার অধিকার তোমাদের কে দিয়েছে?
আপনার স্কুল খুললেও আজকের দিনে আপনাকে এই নিয়মেই চলতে হত মশায়, ব্যাগোড়বাই করলেই স্কুল বন্ধ করে দিত। ওসব মেধা কম্প্রোমাইজ বলে কিছু হয় না স্যার, সব হল পলিসি... জনদরদী পলিসি... তবে আপনারও দোষ আছে মশায়…
আমার দোষ? সে কিরকম?
এই দেখুন, আপনার অনেক অনেক সামাজিক উন্নতির কাজ আছে মানলাম। কিন্তু আপনাকে ওইসব সীতার বনবাস, ভরত-দুষ্মন্ত এসব কে লিখতে বলেছিল মশায়? এমনিতেই দেশটা ধম্মো ধম্মো করে পাগল। অল্প একটু ধম্মের গন্ধ দেখিয়েচেন কি সব ঝাঁপিয়ে পড়বে। অবিশ্যি আপনি কিছু ওদেশের বিজ্ঞানীদের জীবনী টিবনী লিখেছিলেন, কিন্তু হয় না স্যার... হয় না। আপনার লেখাগুলো যা হতে পারত, মানে যুক্তিতে যে ধারভার নিয়ে দাঁড়াতে পারত তা আপনি হতে দিলেন না। আপনি তো হিউমের মত নাস্তিক দার্শনিকের এতবড় ভক্ত ছিলেন। বেদান্তকে পাগলের প্রলাপ টলাপ বলেওছিলেন। তা আপনি মশায় কিছু ঝেড়ে লিখতে পারলেন না? বেশ একটা যুক্তিবাদী দর্শন। না হোক দর্শন না হল, এমনি আমাদের এই এত কুসংস্কারে ভরা চিন্তাভাবনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে কিছু ঝাঁঝালো প্রবন্ধ? আজ অবধি যা পড়ে আমাদের রোমহর্ষণ হত? হিউম বলেন, ভল্টায়ার বলেন তারা তো কোন কালেই সব করে থুয়ে গেছেন। মায় সিসেরোর কথা ভাবেন? সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগেই এসব লিখে দেশ একদম এদিক ওদিক করে গেলেন। আর আমাদের পোড়া দেশ কিছুতেই ওসব ডগম্যাটিক, মিস্টিক চিন্তাভাবনা থেকে বেরোতেই পারল না... বলি আমাদের দেশে একটাও কি খাঁটি যুক্তিবাদী দর্শন সাধারণ মানুষদের মধ্যে ঢোকানো যেত না? মানে আপনি চাইলেই তো পারতেন স্যার... দর্শন তো নাটক লিখেও সাধারণ মানুষের মাথায় ঢোকানো যায়... কেন যে আপনি হতে দিলেন না... তবে তো আম্বেদকর মশায়কে এসব ভাবতে হত না। বেশ একটু যুক্তিবাদী, কমোন সেন্সওয়ালা দেশ হত। তা না, আপনি অভিমান করে কার্মাটাড়ে গিয়ে বসলেন। আর আম্মেদকর রেগেমেগে বৌদ্ধ হলেন। কাজের কাজ কিস্যু হল না মাঝখান থেকে। এই আপনার আসার পরেও কত কত অবতার যে এই জাতপাত করে ধম্মো প্রচার করল কি বলব! জানেন, আমার মনে হয় ফ্রয়েডের মত কেউ একজন আমাদের দেশে জন্মালে আমাদের অবতারের সংখ্যাও কমত। এখন কেমন ওসব ঝক্কি কমে গেছেন দেখেন না? আগে থেকে থেকেই ভর পড়ত....আরও কি কি সব হত..তাই না? তাই বলছিলাম... থাকত আপনার আগামীকালের জন্য লেখা কিছু যুক্তিবাদী লেখা, আহা! কেন যে হল না! বেশ কেমন দেশটা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বেশ একটা যুক্তিনির্ভর কিছু হয়ে উঠত... আমাদের যা ভক্তি করার নেশা মশায়। ঘেন্না করা আমাদের নেশাপেশা মশায়, ওকি আর এত সহজে যায় বলেন? একটু সুযোগ দিয়েছেন কি ব্যস... সব গেল। এটা আপনি ঠিক করলেন বলুন?
ধুম করে স্বপ্ন ভেঙে গেল... দেখি বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শ্রাবণের মেঘ। চারদিকে শাঁখ-ঘন্টা বাজছে। মানে সন্ধ্যে হয়ে গেল। আমি এখন কি করি? যাই দেখি গিয়ে বিদ্যাসাগর মশায়ের কিছু লেখা পড়া যাক। কি পড়ি?