Skip to main content

 

 

 

ফেসবুক থেকে একটু দূরে আছি কয়েকদিন হল, একান্ত ব্যক্তিগত কিছু কারণে। কিছু বই মনের মধ্যে আঁকশি দিয়ে এমন হ্যাঁচকা টান মেরেছে যে 'ডুব দে রে মন' অবস্থা। কিন্তু তবু একবার আসতেই হল। কারণটা সুখকর নয়, একটা ভারবহ কর্তব্যের জন্য।

      আজ খানিক আগে জানলাম রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী স্বামী সত্যস্থানন্দজী মহারাজ একটি দুর্ঘটনায় শিমলার ওদিকে মারা গেছেন। ঘটনাটা শুনে থমকে গেলাম। ওনাকে নিয়ে তেমনভাবে চর্চা হয় তো হবে না, কারণ তেমন কেউকেটা গোছের মানুষ তো তিনি নন, কিন্তু উনি আমার খুব কাছের শ্রদ্ধার মানুষ ছিলেন। তাই ওনাকে নিয়েই দুটো-চারটে নিতান্ত সাধারণ কথা বলতেই লেখা।

      "মঠে ফোন করলে বলবি, স্বামী সত্যস্থানন্দজীকে দিন।"

      "আচ্ছা।"

 

      উনি কাঁচরাপাড়া থেকে ট্রেনে উঠে গেলেন। বেলুড় মঠে ফিরবেন। একটা সভায় বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন, কাঁচরাপাড়াতেই, সালটা হয় তো ১৯৯৬ কি ১৯৯৭ হবে, আমার ঠিক স্মরণে আসছে না। খুব ভালো বাগ্মী ছিলেন তা নন, কিন্তু বড় স্পষ্ট, সোজা কথা বলতেন। নম্রভাবে বলতেন। নম্রভাবে সোজা সত্য কথা বলাটা ওনার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। আমি ওনাকে চিনি না তখন। বিবেকানন্দকে নিয়ে সভা হচ্ছে। আমায় একজন যেতে বলেছিলেন। গেলাম, কিন্তু মন যে দিতে পারছিলাম ঠিক তা নয়। কর্তাব্যক্তিদের অত্যন্ত হামবড়া ভাব, চরিত্র গঠনের ভয়াবহ দুরূহ সব প্যাকেজ ইত্যাদি নিয়ে এমন সব আলোচনা, ভাবছিলাম এলাম কেন রে বাবা! এর চাইতে খানিক দূরেই গঙ্গা, যাই সেখানে গিয়ে বসি। এমন সময় খুব সাদামাটা একজন মানুষ গিয়ে স্টেজে বসলেন। শ্যামলা বর্ণের, বেশ সুগঠিত চেহারা, উজ্জ্বল দুটো চোখ, বাংলা উচ্চারণটা একটু অন্যরকম, সোজা কথায় অ-কলকাতাইয়া। কিন্তু বক্তব্য কি স্পষ্ট! অনাড়ম্বর। স্বাভাবিক। যে কথাটা আমার মনে ধরল, বললেন, “গীতা পাঠের চেয়ে ফুটবল খেলা ভালো... ইত্যাদি কয়েকটা স্লোগান পড়ে স্বামীজিকে বোঝা যায় না। স্বামীজিকে গভীরভাবে পড়তে হবে। দশ খণ্ড রচনাবলীকে ধরে পড়তে হবে। স্বামীজির গ্ল্যামার একটা আছে। কিন্তু সেটা স্বামীজি নয়। স্বামীজির কয়েকটা বাণী এদিক ওদিক থেকে পড়ে স্বামীজিকে জানা যায় না।"

      কোথাও কোনো কথা শুধু কথার কথা মনে হল না, মনে হল মানুষটা যা বলছেন তা অনুভব থেকে বলছেন। কথাগুলো জীবন্ত, সাজানো না। সুন্দর না, সত্য।

      ওনার বক্তৃতা শেষ হলে ওনার সঙ্গে গিয়ে পরিচয় করলাম। আরো ভালো লাগল, ভীষণ সুন্দর হাসি। প্রাণ জুড়িয়ে গেল। পিঠে হাত রেখে বললেন, চলো স্টেশানে যাওয়া যাক। বেশি কিছু কথা হল না। রাস্তায় ভিড়, তার মধ্যেই উনি আমার সম্বন্ধে কিছু কিছু কথা জেনে নিলেন, মঠে দেখা করতে বললেন।

      ক'দিনের মধ্যে বেলুড় মঠে গেলাম। মঠে ঢুকেই বাঁদিকে যে বড় অফিসঘর সেখানে বড় দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা একফালি বারান্দা, সেটা ধরে সোজা গিয়ে বাঁদিকে গেলেই ওনার অফিস। অর্থাৎ, ওনার কাজের জায়গা। আমি ঢুকতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসে বললেন, ওহ্... এসে গেছিস, আয়, বোস। একটা চেয়ার পাশ থেকে টেনে নিতে বললেন।

      মুখোমুখি বসলাম। ওনার সামনে একটা কম্পিউটার খোলা। কিছু কাজ করছিলেন। আমার চোখের উপর চোখ রেখে প্রথম প্রশ্ন করলেন, স্বামীজি পড়েছিস?

- হ্যাঁ

- কোন যোগটা সবচাইতে ভালো লাগে?

- কর্মযোগ

- কেন?

- তা জানি না, তবে ওইটাই আমি হয়তো সব চাইতে ভালো বুঝি।

- হুম। ধর্ম মানে কি বুঝিস?

- স্পষ্ট বুঝি না, তবে এটা মনে হয়, চিত্তশুদ্ধি। এই কথাটা বেশ লাগে।

- মানে কি বুঝিস?

- ভাষায় কি সংজ্ঞা জানি না, কিন্তু মনে হয় মতলবের ঊর্দ্ধে কিছু একটা...

- যন সাধন তন সিদ্ধি... পড়েছিস?

- হ্যাঁ, স্বামীজিকে পাওহারি বাবা বলেছিলেন...

- হুম, মানে হল যেটাই কাজ সেটাই উদ্দেশ্য... যেমন ধর তুই গান গাইছিস... গান গেয়ে কিছু হবে একটা তা না, ওই সময়টায় গানই তোর সব... উদ্দেশ্য ও উপায় দুই-ই এক... বুঝেছিস?...

      এরকম আরো কিছু কথা হল। ঠাকুরের প্রসাদ আনালেন, ফল প্রসাদ, বললেন, আবার আসিস।

      আবার গেলাম। একবার না, বহুবার গেলাম। আত্মীয়তা বাড়ল। স্বামী সুহিতানন্দজীর সঙ্গে পরিচয় করালেন। সে আর এক গল্প। স্বামী সুহিতানন্দজী'র সঙ্গে কথা বলছি, এমন সময় হইহই করে কিছু লোক ঢুকল। পোশাক দেখে, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হল না ওনারা মঠে আসার জন্য এসেছেন বলে। ঢুকেই সুহিতানন্দজীকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল শুরু করল। কারণ হল, তাদের পাড়ার কেউ একজন সাধু হয়ে গেছে মঠে। উনি যত বোঝান এখানে কাউকে জোর করে আনা হয় না, সবাই স্বেচ্ছায় আসে... কিন্তু কে কার কথা শোনে। আমায় উনি ইশারায় বাইরে গিয়ে বসতে বললেন। আমি বাইরে বেরোতে বেরোতে দেখি একজন ওনার গেরুয়া জামার কলার ধরে তুলে দাঁড় করাচ্ছেন... আমি স্পর্ধা দেখে স্তম্ভিত। রাগে আমার কান দপদপ করতে শুরু করল। উনি ইশারায় বাইরে চলে যেতে বললেন। বাইরে এসে দেখি অনেক সন্ন্যাসী ভিড় করে দাঁড়িয়ে। স্বপন মহারাজ (স্বামী সত্যস্থানন্দজী) পায়চারী করছেন। কেউই ভিতরে ঢুকছেন না। আমি একটা বেঞ্চে বসলাম। খানিক বাদে ওরা সব পুলিশের হুমকি দিতে দিতে বাইরে চলে গেল। কয়েকজন সন্ন্যাসী ঢুকলেন ওনার ঘরে। খানিক বাদে ওনারাও বেরিয়ে গেলেন। স্বপন মহারাজ আমায় যাওয়ার আগে বলে গেলেন, যা তোকে ডাকছেন।

      আমি ঢুকতেই একগাল হেসে বললেন, খুব ভয় খেয়েচিলি... ধুর বোকা... কিছুটা রগচটা... তা আমরা কি বলছিলাম যেন...

      আমি অবাক হলাম। একজন মানুষ এতটা নির্বিকার কি করে হন? এই কি গীতার সেই মান-অপমান সমান বোধের ইঙ্গিত?

      আবার স্বপন মহারাজ প্রসঙ্গে আসি। ঠাকুরের জন্মোৎসব, প্রচণ্ড ভিড়। দুপুরে মঠের প্রাঙ্গণে প্রসাদ বিতরণ হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ প্রসাদ পাচ্ছেন বসে। একজন বৃদ্ধাকে দেখলাম একটা টিফিন কৌটো হাতে একটু দূরে দাঁড়িয়ে, ভীষণই দরিদ্র। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে? উনি বললেন, আমার বাড়িতে অসুস্থ মানুষ, আমি একটু যদি খিচুড়ি নিয়ে যাই, ওর খাওয়া হয়ে যায়। বললাম, আপনি যাচ্ছেন না কেন চাইতে?

      মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। বুঝলাম, আসলে পোশাক একটা সামাজিক অধিকার নির্ণয়ের বড় বালাই। আমি টিফিন কৌটো হাতে নিয়ে ভিড় ঠেলে খুঁজলাম স্বপন মহারাজকে। জানি উনি কোথাও না কোথাও আছেন, দেখেছি খানিক আগেই। পেয়ে গেলাম, হাতের টিফিন কৌটো দেখিয়ে বললাম, আমার এতে প্রসাদ চাই। একজন বাইরে অপেক্ষা করছেন।

      স্বপন মহারাজ আমার মুখের দিকেও তাকালেন না, ভীষণ ব্যস্ত। আমার হাতটা ধরে বললেন, আয়।

      ভিড় ঠেলে এগিয়ে প্রসাদের গাড়ির সামনে এসে আমার হাত থেকে কৌটোটা নিয়ে ঠেসে খিচুড়ি ভরলেন। তারপর ঢাকনাটা লাগিয়ে আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, পালা।

      খিচুড়ির কৌটো নিয়ে ভিড় ঠেলে এগোতে এগোতে বুঝলাম, অনেক সময়ই চোখের দিকে তাকাতে নেই। কিছু কাজ নিজেকে সরিয়ে নিঃশব্দে করে ফেলতে হয়। চোখাচোখি হতে নেই।

 

      মানুষটা ভীষণ গান ভালোবাসতেন। একদিন কথাপ্রসঙ্গে যশরাজজী'র ‘ভরত ভাই কপিসে উরিন হাম নাহি’ আর ‘রাণি তেরো চির জিও গোপাল’ গানটার কথা হল। আমি মুগ্ধ হয়ে গান দুটো নিয়ে বলছি। উনি শুনছেন। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। একটু পরেই আরতি শুরু হবে। কি কুণ্ঠা নিয়ে আমায় বললেন, আমায় শোনাবি পরের বার?

      আমি পরেরবার ক্যাসেটে রেকর্ড করে যশরাজজী'র পুরো ক্যাসেটটার সব গানই নিয়ে গেলাম। হাতে দিতেই কি খুশী। বাচ্চাদের মত খুশী। তারপর যতবার ওনার সঙ্গে দেখা হয়েছে এমন একদিনও যায়নি উনি ওই ক্যাসেটের উল্লেখ না করেছেন। প্রতিবার বলেছেন। কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। আমি লজ্জা পেয়েছি।

      এরপর নানা কারণে আমার মঠে যাওয়া কমে যেতে শুরু করে। ফোনে কথা হয় মাঝে মাঝে। ক্রমে জীবনের গতিপথ মোড় নেয় বাঁকে বাঁকে। কথা কমে আসতে শুরু করে। বছর তিনেক আগে আমার সঙ্গে ওনার শেষ কথা হয়। উনি শিলচরে। আমায় বলেছিলেন, আমি যেখানেই থাকি, তোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক থেকে যাবেই যাবে। কোনো অসুবিধা হলেই নির্দ্বিধায় আমার কাছে চলে আসিস।

      এমন দুর্ঘটনায় মৃত্যু কেন? এ প্রশ্ন অবান্তর। আসলে এতটা রাস্তা পেরিয়ে এসেছি, এখন বুঝি জীবনে অনেক সময়েই ‘কেন’ প্রশ্নটা অবান্তর। ‘কিভাবে’ এর উত্তর সব সময়েই আছে। কিন্তু কেন – এর উত্তর কে দেবে? পাপ-পুণ্য, কর্মফল, দৈব – ইত্যাদি সব অর্থহীন শব্দমালা। শিশুর জুজুবুড়ি। ওতে একটা সান্ত্বনা আছে, আপাত ব্যাখ্যা আছে, কিন্তু পুরোটাই অবশেষে ফাঁকি।

      অমন মহৎ হৃদয়ের উদ্দেশ্যে আমার প্রণাম জানাই। শোক নেই। কারণ জীবনটা বড় খাঁটি ছিল। তবে কষ্ট পাচ্ছি, তবু মন জিজ্ঞাসা করছে অনর্থক – কেন কেন কেন? উনি হয় তো মাথায় গাঁট্টা মেরে বলবেন, সব কি জানা যায় রে ছোঁড়া... শুধু নৌকার মুখটা ঠিক রাখ। ডুবে গেলে যাবি, শুধু অসৎ দরিয়ায় ডুবিস না।

 

(মহারাজ, আমি কোনোদিন ভাবিনি এভাবে আপনাকে নিয়ে লিখতে হবে। অনেক কিছু সহ্য করে নিয়েছি, এও সহ্য হয়ে যাবে। ভালো থাকবেন, আমার মত অনেক মানুষের ভালোবাসার স্মৃতিতে। অপঘাতে শরীর যায়, ভালোবাসা না। প্রণাম ও আলিঙ্গন জানবেন।)