Skip to main content

স্বামীজির যে কয়েকটা লেখা আমাকে ভীষণ আলোড়িত করেছিল, আজও করে, তার মধ্যে একটা লেখা আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লেখা একটা চিঠি, ২০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩ সালে লেখা। চিঠিটা দিচ্ছি, তবে আর দুটো কথা বলে নিই।

       আজ যখন প্রতিমা মিশ্র প্রমুখ মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিকের দুঃসাহসিক প্রাণপণ লড়াই দেখছি, এবং মাঝে মাঝে ফেসবুকে বেশ কিছু গণ্যমান্য, উচ্চপদস্থ মানুষের নিরাশাজনক পোস্ট দেখছি, তখন আমার বারবার এই চিঠিটার কথা মনে পড়ছিল। সেই নিরাশাজনক পোস্টের মধ্যে কম বেশি খ্যাতনামা কিছু কবিকূলও আছেন। অবশ্যই নিরাশার মধ্যে যে ভাববিলাসিতা আছে তা কাব্য ও সেল্ফ-পিটির একটা প্রধান উপজীব্য। স্বামীজি নিরাশাবাদের একটা বড় কারণ বলতেন ভগ্নস্বাস্থ্য, যদিও ব্যতিক্রম নিশ্চয় আছেন, কিন্তু মূলত তাই। তাই একসময় গীতা পাঠের থেকে ফুটবল খেলাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। জানি না আমাদের কবিমহলে পিরিয়ডিক স্বাস্থ্যপরীক্ষার রীতি আছে কিনা, তবে তা খুব দরকার। কারণ ভগ্নস্বাস্থ্যে নিরাশা এক অবশ্যম্ভাবী ফল। আরেকটা কারণ অবশ্য অভ্যাস ও একটা অদ্ভুত ধারণা, ঠিক নিরাশাবাদী না হলে বুদ্ধিজীবী হওয়া যায় না হয় তো। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটা লাইন মনে পড়ল -

 

"যথাসাধ্য-ভালো বলে, ওগো আরো-ভালো,

কোন্ স্বর্গপুরী তুমি ক'রে থাকো আলো।

আরো-ভালো কেঁদে কহে, আমি থাকি হায়

অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায়।"

 

তো কথা হচ্ছে, আর কদিন যাক না, তারপর তো রইলেনই আপনারা ভীষণ নিরাশার সাতকাহন নিয়ে। কিন্তু এই যে একটা আলোড়ন অবশেষে দেশজুড়ে উঠল, তাকে কি শুধুই রাজনীতি বলে দূরে ঠেলে রাখতে পারেন? পারলে আর ওই ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল বলে স্লোগান দেওয়া কি ভালো দেখায়?... হবে হবে, আপনাদের ভবিষ্যৎ বাণী অনুযায়ী আরো দুর্ঘটনা ঘটবে...আবার আলোড়ন হবে.... কেন বলুন তো? সোজা হিসাব। আপনি একদিন মারা যাবেন বলে কি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে বসে আছেন? না রোগের চিকিৎসা না করে শ্মশানে গিয়ে শুয়ে আছেন? মানুষ তো ক্যান্সার হলেও লড়ে যায় শেষ পর্যন্ত, যায় না? যায় তো। অথচ আপনি জানেন এত ভালো ভালো খেয়েও, এত সুচিকিৎসার সুবিধা থাকতেও আপনাকে মরতে হবে। তবু আপনি বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন, তাই তো? ঠিক। এই মানসিকতাটাই যদি "আমি ও আমার" থেকে বাইরে আনেন, দেখবেন আপনিও আপনার ভাবনার মধ্যে জীবনীশক্তি ফিরে পাচ্ছেন। তাই আপাতত সে বিলাসিতা থাক। যেদিন প্রায়োপবেশনে বসবেন, সেদিন না হয় শুনব। সেদিন আপনার "আমি ও আমার" আর "তুমি ও তোমার" সব একাকার হয়ে যাবে। অনেক লিখে ফেললাম, চিঠিটা আসুন পড়াই..এবং পড়তে পড়তে মনে রাখবেন, এটা কিন্তু একটা চিঠি... হ্যাঁ চিঠি, ভাষণ না... একটা মানুষের ব্যক্তিগত অনুভবের বহিঃপ্রকাশ... আসুন পড়ি...

 

"নিরাশ হইও না। স্মরণ রাখিও, ভগবান্ গীতায় বলিতেছেন, ‘কর্মে তোমার অধিকার, ফলে নয়।’ কোমর বাঁধো, বৎস, প্রভু আমাকে এই কাজের জন্য ডাকিয়াছেন। সারা জীবন আমার নানা দুঃখযন্ত্রণার মধ্যেই কাটিয়াছে। আমি প্রাণপ্রিয় আত্মীয়গণকে একরূপ অনাহারে মরিতে দেখিয়াছি। লোকে আমাকে উপহাস ও অবজ্ঞা করিয়াছে, জুয়াচোরে বদমাশ বলিয়াছে (মান্দ্রাজের অনেকে এখনও আমাকে এইরূপ ভাবিয়া থাকে)। আমি এ সমস্তই সহ্য করিয়াছি তাহাদেরই জন্য, যাহারা আমাকে উপহাস ও ঘৃণা করিয়াছে। বৎস! এই জগৎ দুঃখের আগার বটে, কিন্তু ইহা মহাপুরুষগণের শিক্ষালয়স্বরূপ। এই দুঃখ হইতেই সহানুভূতি, সহিষ্ণুতা, সর্বোপরি অদম্য দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির বিকাশ হয়, যে শক্তিবলে মানুষ সমগ্র জগৎ চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া গেলেও একটু কম্পিত হয় না। যাহারা আমাকে ভণ্ড বিবেচনা করে, তাহাদের জন্য আমার দুঃখ হয়। তাহাদের কিছু দোষ নাই। তাহারা শিশু, অতি শিশু, যদিও সমাজে তাহারা মহাগণ্যমান্য বলিয়া বিবেচিত। তাহাদের চক্ষু নিজেদের ক্ষুদ্র দৃষ্টিসীমার বাহিরে আর কিছু দেখিতে পায় না। তাহাদের নিয়মিত কার্য—আহার, পান, অর্থোপার্জন ও বংশবৃদ্ধি—যেন গণিতের নিয়মে অতি সুশৃঙ্খলভাবে পর পর সম্পাদিত হইয়া চলিয়াছে। ইহার অতিরিক্ত আর কিছু তাহারা জানে না। বেশ সুখী তাহারা! তাহাদের ঘুমের ব্যাঘাত কিছুতেই হয় না। শত শত শতাব্দীর পাশব অত্যাচারের ফলে সমুত্থিত শোক, তাপ, দৈন্য ও পাপের যে কাতরধ্বনিতে ভারতাকাশ সমাকুল হইয়াছে, তাহাতেও তাহাদের জীবন সম্বন্ধে দিবাস্বপ্নের ব্যাঘাত হয় না! সেই শত শত যুগব্যাপী মানসিক, নৈতিক ও দৈহিক অত্যাচারের কথা যাহাতে ভগবানের প্রতিমাস্বরূপ মানুষকে ভারবাহী গর্দভে এবং ভগবতীর প্রতিমারূপা নারীকে সন্তান ধারণ করিবার দাসীস্বরূপা করিয়া ফেলিয়াছে এবং জীবন বিষময় করিয়া তুলিয়াছে, এ কথা তাহাদের স্বপ্নেও মনে উদিত হয় না। কিন্তু অন্যান্য অনেকে আছেন, যাঁহারা দেখিতেছেন, প্রাণে প্রাণে বুঝিতেছেন, হৃদয়ের রক্তময় অশ্রু বিসর্জন করিতেছেন; যাঁহারা মনে করেন, ইহার প্রতিকার আছে, আর প্রাণ পর্যন্ত পণ করিয়া যাঁহারা ইহার প্রতিকারে প্রস্তুত আছেন। ‘ইহাদিগকে লইয়াই স্বর্গরাজ্য বিরচিত।’ ইহা কি স্বাভাবিক নহে যে, উচ্চস্তরে অবস্থিত এই সকল মহাপুরুষের—ঐ বিষোদ্গিরণকারী ঘৃণ্য কীটগণের প্রলাপবাক্য শুনিবার মোটেই অবকাশ নাই?

       গণ্যমান্য, উচ্চপদস্থ অথবা ধনীর উপর কোন ভরসা রাখিও না। তাহাদের মধ্যে জীবনীশক্তি নাই—তাহারা একরূপ মৃতকল্প বলিলেই হয়। ভরসা তোমাদের উপর—পদমর্যাদাহীন, দরিদ্র, কিন্তু বিশ্বাসী—তোমাদের উপর। ভগবানে বিশ্বাস রাখো। কোন চালাকির প্রয়োজন নাই; চালাকি দ্বারা কিছুই হয় না। দুঃখীদের ব্যথা অনুভব কর, আর ভগবানের নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর—সাহায্য আসিবেই আসিবে। আমি দ্বাদশ বৎসর হৃদয়ে এই ভার লইয়া ও মাথায় এই চিন্তা লইয়া বেড়াইয়াছি। আমি তথাকথিত অনেক ধনী ও বড়লোকের দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়াছি, তাহারা আমাকে কেবল জুয়াচোর ভাবিয়াছে। হৃদয়ের রক্তমোক্ষণ করিতে করিতে আমি অর্ধেক পৃথিবী অতিক্রম করিয়া এই বিদেশে সাহায্যপ্রার্থী হইয়া উপস্থিত হইয়াছি। আর আমার স্বদেশের লোকেরাই যখন আমায় জুয়াচোর ভাবে, তখন আমেরিকানরা এক অপরিচিত বিদেশী ভিক্ষুককে অর্থ ভিক্ষা করিতে দেখিলে কত কী-ই না ভাবিবে? কিন্তু ভগবান্ অনন্তশক্তিমান্; আমি জানি, তিনি আমাকে সাহায্য করিবেন। আমি এই দেশে অনাহারে বা শীতে মরিতে পারি; কিন্তু হে মান্দ্রাজবাসী যুবকগণ, আমি তোমাদের নিকট এই গরীব, অজ্ঞ, অত্যাচার-পীড়িতদের জন্য সহানুভূতি, এই প্রাণপণ চেষ্টা—দায়স্বরূপ অর্পণ করিতেছি। যাও, এই মুহূর্তে সেই পার্থসারথির মন্দিরে—যিনি গোকুলের দীনদরিদ্র গোপগণের সখা ছিলেন, যিনি গুহক চণ্ডালকে আলিঙ্গন করিতে সঙ্কুচিত হন নাই, যিনি তাঁহার বুদ্ধ-অবতারে রাজপুরুষগণের আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করিয়া এক বেশ্যার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া তাহাকে উদ্ধার করিয়াছিলেন; যাও, তাঁহার নিকট গিয়া সাষ্টাঙ্গে পড়িয়া যাও, এবং তাঁহার নিকট এক মহা বলি প্রদান কর; বলি—জীবন-বলি তাহাদের জন্য, যাহাদের জন্য তিনি যুগে যুগে অবতীর্ণ হইয়া থাকেন, যাহাদের তিনি সর্বাপেক্ষা ভালবাসেন, সেই দীন দরিদ্র পতিত উৎপীড়িতদের জন্য। তোমরা সারা জীবন এই ত্রিশকোটি ভারতবাসীর উদ্ধারের জন্য ব্রত গ্রহণ কর, যাহারা দিন দিন ডুবিতেছে।

       এ এক দিনের কাজ নয়। পথ ভীষণ কণ্টকপূর্ণ। কিন্তু পার্থসারথি আমাদের সারথি হইতেই প্রস্তুত, তাহা আমরা জানি। তাঁহার নামে, তাঁহার প্রতি অনন্ত বিশ্বাস রাখিয়া ভারতের শতশতযুগসঞ্চিত পর্বতপ্রমাণ অনন্ত দুঃখরাশিতে অগ্নিসংযোগ করিয়া দাও, উহা ভস্মসাৎ হইবেই হইবে।

       তবে এস, ভ্রাতৃগণ! সমস্যাটির অন্তস্তলে প্রবেশ করিয়া ভাল করিয়া দেখ! এ ব্রত গুরুতর, আমরাও ক্ষুদ্রশক্তি। কিন্তু আমরা জ্যোতির তনয়, ভগবানের তনয়। ভগবানের জয় হউক—আমরা সিদ্ধিলাভ করিবই করিব। শত শত লোক এই চেষ্টায় প্রাণ ত্যাগ করিবে, আবার শত শত লোক উহাতে ব্রতী হইতে প্রস্তুত থাকিবে। প্রভুর জয়! আমি এখানে অকৃতকার্য হইয়া মরিতে পারি, আর একজন এই ভার গ্রহণ করিবে! রোগ কি বুঝিলে, ঔষধ কি তাহাও জানিলে, কেবল বিশ্বাসী হও। আমরা ধনী বা বড়লোককে গ্রাহ্য করি না। আমরা হৃদয়শূন্য মস্তিষ্কসার ব্যক্তিগণকে ও তাহাদের নিস্তেজ সংবাদপত্রের প্রবন্ধসমূহও গ্রাহ্য করি না। বিশ্বাস, বিশ্বাস, সহানুভূতি, অগ্নিময় বিশ্বাস, অগ্নিময় সহানুভূতি। জয় প্রভু, জয় প্রভু। তুচ্ছ জীবন, তুচ্ছ মরণ, তুচ্ছ ক্ষুধা, তুচ্ছ শীত। জয় প্রভু! অগ্রসর হও, প্রভু আমাদের নেতা। পশ্চাতে চাহিও না। কে পড়িল দেখিতে যাইও না। এগিয়ে যাও, সম্মুখে, সম্মুখে। এইরূপেই আমরা অগ্রগামী হইব—একজন পড়িবে, আর একজন তাহার স্থান অধিকার করিবে।" - স্বামী বিবেকানন্দ