সুরমার সঙ্গে এটা খুব হচ্ছে। আগে মাসে একবার কি দু'বার হয় তো হত, এখন প্রতিদিন হচ্ছে।
আজ সকালেই, রান্নার পর গ্যাসট্যাস মুছে বসার ঘরে খবরের কাগজটা নিয়ে বসল। অতীন মিউনিসিপালিটি চলে গেছে। মেয়ে টিউশানে। এখন কেউ আসার নেই। যেই ভেবেছে খানিক বাদেই কলিংবেল বাজল, মাসতুতো দিদি আর তার বর। মানে আবার গ্যাস জ্বালো। নইলে আপ্যায়ন হবে কি করে?
গতকাল রাতে শুতে যাওয়ার আগে তালাটালা লাগিয়ে ভাবল যাক, আর কাল সকালের আগে নীচে নামার হুজ্জুতি নেই। বিছানায় পিঠ ঠেকিয়েছে অমনি কুকুরের কান্নার আওয়াজ। মানে বাইরের গেট খোলা ছিল কখন ঢুকে পড়েছে, আর এখন বেরোতে পারছে না। অগত্যা আবার নামো। তালা খোলো।
এত ছোটো ছোটো বিষয়ে এটা বারবার হচ্ছে যে সুরমার ভয় লাগছে মাঝে মাঝে। মানে কি ঠাকুর অসন্তুষ্ট তার উপর? কোনো বাজে কিছু হতে চলেছে? সুরমার পরিবারে স্বচ্ছলতার অভাব নেই। অতীনের মাইনের থেকে উপরি যথেষ্ট বেশি। একটা সমস্যা অবশ্য সুরমার আছে, মাথায় চুল নেই। উইগ পরলে চুলকায়, অ্যালার্জি। অনেক ওষুধপত্র, থেরাপি করেছে। কাজ হয়নি কিছুতেই। এখন মেনে নিয়েছে। পাড়াপ্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, মুন্নার বান্ধবীরা, স্যারেরা, টিউটরেরা, বাড়ির কাজের মেয়েটা, রান্নার দিদি --- সবাই জানে তার মাথায় টাক। নতুন যারা কথা বলতে বলতে বারবার তার মাথার দিকে তাকায়। সব্জী বিক্রি করতে আসে যে ছেলেটা সেও কথায় কথায় তার মাথার দিকে তাকায়। মন্দিরে গেলে পুরোহিত, স্টেশানে গেলে ট্রেনচারী, রাস্তায় বেরোলে পথচারী, লঞ্চে উঠলে জলচারী। সবাই তাকায়। তবে কেউ ঘাঁটায় না। কারণ সুরমার জিভে ধার আছে যথেষ্ট। নানারকম ব্লেড। যখন যেমন দরকার। মিথ্যাকথা বলতেও তার জুড়ি নেই। মাঝে মাঝেই ভাবে সিরিয়ালগুলো যে কেন তাকে লিখতে দেয় না। এই যেমন মুন্নার লাইফ সায়েন্সের স্যারকে ঢপ দিল ক'দিন আগেই। সুরমার একটা নিয়ম আছে। কোনো টিউটারের কাছে ছ'মাসের বেশি রাখে না। কারণ সুরমার মনে হয় একজন স্যার বা ম্যাডামের ছ'মাসের বেশি নতুন কিছু শেখানোর ক্ষমতা থাকে না। তো লাইফ সায়েন্স স্যারকে ঢপ দিল যে মুন্না ছ'মাসের জন্য ঢাকায় যাচ্ছে। ব্যস, হয়ে গেল আবার অন্য স্যার। সুরমার বিশ্বাস স্যারেদের যদিও বা ছ'মাসের বেশি একমাস আরো পড়ানোর ধক থাকে, ম্যাডামদের তো আরো থাকে না। মেয়েদের শিক্ষার থেকে রূপ আর ছলকলার কৌশলে বেশি বিশ্বাস সুরমার। মুন্নাকে কথায় কথায় ঠোকে, ওকি ছেলেদের মত হাঁটা, ওকি ছেলেদের মত কথা বলা, ওকি ছেলেদের মত বসা, ওকি ছেলেদের মত খেলা দেখা... ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে মুন্না যথেষ্ট ন্যাকা তৈরি হয়েছে। তাতে সুরমা আর অতীন দু'জনেই যথেষ্ট উচ্ছ্বসিত। পরীক্ষাও করে দেখেছে একবার। তার ছোটো পিসী'র মেয়ের বিয়েতে মেয়েকে নিয়ে গেল। এমনিতে ভীষণ যত্নে রাখে। চট্ করে অদরকারে বাড়ির বাইরে বের করে না। এমনকি শীতকালে পড়তে গেলেও কুশন দিয়ে পাঠায়, পাছার তলায় দিয়ে বসে যাতে। ঠাণ্ডা লাগলে কে ঝক্কি পোয়াবে?
তো বিয়েবাড়িতে বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে গেল মেয়েকে। সুরমার সৌন্দর্যের বোধটা একটু অন্যধারার। মেয়েদের কেশহীন বগল সুরমার মনে হয় একটা অ্যাপিল করে ছেলেদের। ফ্রক থাকবে হাঁটুর উপর অবধি। চুল থাকবে খোলা। স্তন থাকবে অর্ধাবৃত। নিতম্ব থাকবে পোশাক ছিঁড়ে বেরোতে চাওয়া অবাধ্য। সংযম আর অসংযমের মধ্যে দাঁড়িয়ে সৌন্দর্যতা। এটা সবাই বোঝে না। বুদ্ধদেব গুহ বুঝতেন। ওই যে 'মাধুকরী' উপন্যাসে আছে না, পৃথু নিজের কুর্চিকে শিশু ভেবে ন্যাপি পরিয়ে, পাওডার-টাওডার মাখিয়ে, স্নান করিয়ে, আদর করার কথা ভাবে? এও এক ধরণের আদর। এটা শুনে অতীন বলেছিল বুদ্ধদেববাবু কি পিডোফিলিক বলতে চেয়েছেন পৃথুকে? মানে উপন্যাসের নায়ককে? সুরমা হেসেছিল। পুরুষেরা বিদ্যা খোঁজে না, মায়া খোঁজে।
সেদিন বিয়েবাড়িতে মুন্নাই জিতেছিল। আরো আরো আত্মীয়ের মেয়েরা তো ছিল, তারা অনেকেই মুন্নার সমবয়েসী, পড়াশোনায় মুন্নার চাইতেও ভালো, দেখতে শুনতেও ভালো। কিন্তু মুন্নার সঙ্গে পারল? মায় বুড়োহদ্দগুলো অবধি স্নেহের ছদ্মবেশে মুন্নাকে চেখে যাচ্ছিল। সুরমার গর্বে বুকটা ফুলে যাচ্ছিল। সে নারীবাদী নয়। সমাজ চিরটাকাল পুরুষতান্ত্রিক থাকবে। এখন এই পুরুষদের বশ করে কি করে নিজেরটা গুছিয়ে চলতে হয় সেটা শিখতে হবে। প্রকৃতি সেইভাবে তৈরি করেওছে তো মেয়েদের। মোহিনীবিদ্যা কি মেয়েদের সহজাত? তবে সহজাত বলে ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে হবে না, তাকে চর্চা করে বাড়াতেও হবে!
এই যে তার মাথায় এতবড় টাক, অতীনের স্পর্ধা আছে একদিনও বলার, তুমি আত্মীয়ের বাড়ি যেও না, কি অনুষ্ঠান বাড়ি যেও না গো, আমার লজ্জা লাগবে --- এ কথা বলতে চাইবে? ঘাড়ে ক'টা মাথা ওর? তাছাড়া পুরুষদের সঙ্গে প্রতিস্পর্ধাও দেখাতে হয়। তাকে উস্কে দিয়ে রণক্ষেত্রে নামাতে হয়, তারপর খানিক যুদ্ধ করে সুকৌশলে হেরে যেতে হয়। পুরুষ যেন বুঝতে না পারে, পারলে উলটো বিপত্তি। পুরুষের উণ্ডেড ইগো বড় স্ট্রেসফুল, ফ্রাস্ট্রেটিং। তাই সুকৌশলে তাকে জিতিয়ে দিতে হয়। পুরুষের পৌরুষকে মাঝে মাঝে এরকম খেলায় ডেকে নাচিয়ে ঘামিয়ে তরতাজা না রাখলে সংসারে লক্ষ্মী থাকে না। তাই তো লক্ষ্মী বারোমাস নারায়ণের পদসেবা করে করে নারায়ণের পৌরুষকে তোয়াজ করে রাখেন।
তো যে কথাটা দিয়ে শুরু হয়েছিল। ইদানীং সুরমা যা-ই ভাবছে, তার উল্টোটা কেন হচ্ছে বুঝছে না সুরমা। এদিকে বাড়িতে নারায়ণ পুজো দেওয়া হয়ে গেছে। কালীবাড়ি, বারের ঠাকুর থেকে শুরু করে ইতুপুজো, মনসাপুজো অবধি দেওয়া হয়ে গেছে। চুলের জন্যেও এত মানত করেনি যতটা এই অদ্ভুত ঘটনাটার জন্য করছে। চুল নিয়ে আক্ষেপ তো একটাই, বিক্রি করা যায় না। পাড়ার সব বউরা, মেয়েরা কেমন সারা মাস মাথার চুল জমিয়ে রেখে বিক্রি করে দেয়। চুল কিনতে বাড়ির সামনেই আসে ফেরিওয়ালা। কেউ বাসন রাখে, কেউ টাকা নেয়। যার যেমন দরকার। সুরমা সেই সময়টা বাইরে বেরোয় না। দু-একবার যাও বা মুখোমুখি হয়ে গিয়েছিল ওই চুল বিক্রিবাট্টার সময়, পাড়ার বউ-মেয়েগুলো তাকে নিয়ে খিল্লি করছে বেশ বুঝতে পারছিল। একবার তো স্কুটি নিয়ে মুন্নাকে পিছনে বসিয়ে ফিরছে, আর প্রায় চুল নিতে আসা লোকটার ঘাড়ে গিয়ে পারলে পড়ে। সে কি হাসি সবার। কে যেন বলল, হিংসায়, রাগে নাকি ওকে প্রাণে মারার চেষ্টা করছে সে। ন্যাকার দল যত!
সুরমা এই বিষয়টা নিয়ে ইন্টারনেট সার্চ করল। কিছু পেল না তেমন। তবু যা মনে ভাবছে তার উল্টোটা হয়েই যাচ্ছে। নাইটি পরে বসে বসে নেটফ্লিক্সে 'ডাউনটাউন অ্যাবি' দেখছে, মনে জানে এই দুপুরে আর শাড়িটাড়ি পরার দরকার নেই। ও বাবা, মিউনিসিপালিটি থেকে ফোন, অতীনের কলিগ মুন্নাকে আর তাকে যেতে বলেছে এখনই, সিনেমায় যাবে। কোনো মানে হয়? না বলা যাবে না। এই বন্ধুটির আবার উপর মহলে অনেক জানাশোনা। এই করোনার মধ্যে না গেলেই নয়, তাও বলা যাবে না। ভ্যাক্সিন নেওয়া। তবে?
মুন্নাকে নিয়ে স্কুটিতে উঠেই সুরমা জোর করে মনে মনে ভাবল আজ সিনেমা সে দেখবেই। যদি উল্টোটা হয়ে যায়। ডাউনটাউনটা দারুন জায়গায় ছেড়ে এসেছে, ম্যাথিউ কি আদৌ উঠে দাঁড়াবে? কাকে বিয়ে করবে? এক ফুল, দুই মালী অবস্থা….
মা... মা…. মা…..
স্কুটি স্লিপ করে ড্রেনে। চিৎপাত হয়ে সুরমা আর মুন্না রাস্তায়।
সুরমার ডান পায়ের একটা হাড় ভেঙেছে। সুরমার বেডরেস্ট এখন। শুয়ে শুয়ে ভাবছে এইবার টানা ডাউনটাউন অ্যাবি দেখে ফেলা যাবে। একটা এপিসোড শেষ হতে না হতেই টিভিটা বন্ধ হল। খারাপ। দোকানে দেওয়া হল, পনেরোদিনের আগে পাওয়া যাবে না। অতীন বলল, থাক, এটা আর সারিয়ে কাজ নেই। সামনেই পুজো, নতুন টিভি কিনে নিলে হবে। হবে না?
সুরমা কিচ্ছু বলল না। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল। দু-একবার মাথায় হাত বুলিয়ে নিজেকে বলল, সব ছেড়ে দেব। সন্ন্যাসিনী হব। সংসারে কি আছে, কিচ্ছু নেই।
ভাবনাটা শেষ হতে না হতেই বোনের ফোন। "দিদি... মা এবার তোর জন্যে আর আমার জন্য যা শাড়ি পাঠিয়েছে না একটা... আরে পেনশান দ্বিগুণ হল না মায়ের এবছর... আরে হ্যাঁ তো…. কম করে বাইশ হাজার তো হবেই... বেশি হবে তো কম না….."
সুরমার চোখে জল এলো। অতীনকে ডেকে বলল, একটু বাইরে যাও না, মেয়েটা অনেকদিন বিরিয়ানি খায়নি, সবার জন্যে নিয়ে এসো…..