কৃষ্ণ ঠুমরি থেকে শুরু করে কত যে চটুল গানে আছেন, সে এক আশ্চয্যি ব্যাপার। কৃষ্ণকে বাদ দিলে ভারতীয় সঙ্গীতের এক বিরাট অংশের উপাদান হারিয়ে যাবে। কি নিয়ে গান বাঁধা হবে? প্রেমকে কোন আয়নায় দেখা হবে? সে তো দেখা হবে বৃন্দাবনে, যমুনায়, মায় নদীয়াতেও।
কৃষ্ণ গীতাকে ছাপিয়ে এত কাছের মানুষ হলেন কি করে? গানে। সুর নীতিকে ছাপিয়ে যায়। কৃষ্ণ বিধিবিধান ছাপিয়ে গেলেন। পণ্ডিত রবিশঙ্কর বলছেন, কৃষ্ণ আমাদের সংস্কৃতিতে এমনভাবে মিশে তোমার মনে হবে যেন তিনি এই মাত্র বৃন্দাবনের যে কোনো গলি দিয়ে বেরিয়ে আসবেন। এই আশেপাশেই কোথাও আছেন।
কৃষ্ণ ভগবান কম, অনুভব বেশি। মানুষ সব কিছুকে সংজ্ঞায় বাঁধতে বাঁধতে যখন ক্লান্ত, যখন সে নিজের বুদ্ধি-বিচার হিসাবনিকাশ থেকে চায় ছুটি, তখন সে বাঁশির সুর খোঁজে। অনুভবের সংজ্ঞা হয় না। সংজ্ঞা হলে অনুভব থাকে না। অনুভবের পদচিহ্ন থাকে। তা দিয়ে গবেষকের কাজ মিটতে পারে, রসিকের নয়।
কবি কৃষ্ণকে যে রসে সৃষ্টি করেছেন তা সত্যের সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাবের সত্য, বস্তুর সত্য নয়। ভাবের সত্যকে বিচারে জানা যায় না। বোধে বোধ করা যায়। যার বোধ হয়েছে তার বেতালে পা পড়ে না। সমস্যা আধজাগা আর ঘুমন্ত চেতনাকে নিয়ে। জাগ্রত চেতনায় ভয় নেই। তাই শাসন নেই। বিধিনিষেধ নেই। ভাবের সত্য যেখান থেকে শুরু সেখান থেকে যাত্রা শুরু রুমি, আমির খসরু, লালন, জয়দেব, বিদ্যাপতি, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের। গীতগোবিন্দ পড়ে আধাচেতন মানুষ বলে, অশ্লীল। চেতন মানুষ বলে, আহা! রাধা অনুভবের গতি। কৃষ্ণ সে গতির অভিমুখ। পথ ও গন্তব্য দুয়ে মিলে এক। পথ আর গন্তব্য এক হলে তাকে বলে লীলা। যেমন বেড়াতে যাওয়া আর কাজে যাওয়া। কাজে যাওয়া কাজের জায়গায় গিয়ে শুরু হয়, কাজ ফুরালেই শেষ হয়। আর বেড়াতে যাওয়া বাড়ির বাইরে পা দিলেই শুরু হয়ে যায়। শেষ আর হয় না। রেশ থেকে যায়। এও তেমন। কৃষ্ণ কবির মানসসম্পদ। তা দিয়ে ছবি আঁকা যায়, গান গাওয়া যায়। তা দিয়ে ধ্বংসের বীজ বোনা যায় না।
মহাপ্রভু সুর দিলেন। নানক সুর দিলেন। মীরা সুর দিলেন। কবীর সুর দিলেন। সুরদাস সুর দিলেন। জয়দেব সুর দিলেন। বিদ্যাপতি সুর দিলেন। পদের পর পদ রচনা হল। আজও হচ্ছে। ভবিষ্যতেও হবে। ভালোবাসা সুরকে জাগায়। কৃষ্ণ মানে শুধু স্তব নয় তাই, কৃষ্ণ মানে কানহাইয়া, কালা, শ্যাম… কৃষ্ণ মানে ঠুমরি, গ্রামের সঙ্গীত। সর্বত্র কৃষ্ণ।
তবে শাস্ত্রের কৃষ্ণের সঙ্গে অশাস্ত্রের কৃষ্ণের বিরোধ হয় না? হত যদি হৃদয় মস্তিষ্কের দাস হত চিরকালের। মস্তিষ্ক যখন হৃদয়ের সুরে মজে যায় তখন শাস্ত্র ভেসে যায়। সুরে সমর্পণের আকুতি জাগে। কণ্ঠ সুরে আত্মসমর্পণ করে। কণ্ঠে হৃদয় আত্মসমর্পণ করে। সুর কৃষ্ণময় হয়ে ওঠে। হৃদয় কৃষ্ণময় হয়ে ওঠে। শাস্ত্র? কে শুনবে আর কে ব্যাখ্যা করবে? সব ব্যাখ্যা শেষ। প্রেম সাড়া দিয়েছে। ডাক এসেছে। শর্ত একটাই, প্রেমের সুখে সুখী হও, স্বার্থসুখকে জলাঞ্জলি দাও। এসো। আর কাউকে না পাও রবীন্দ্রনাথ তো আছেনই। আমাদের আধুনিকতম বৈষ্ণব কবি, ভানুসিংহ। সে কি শুধু ভানুসিংহের পদাবলীতেই?… রবীন্দ্রনাথ তো আজীবন অভিসারের পথে…. ভানুসিংহই তো পথ… পাথেয়.. আনন্দ… অধরম মধুরম…. সব মধুর… চোখের উপর চোখ পড়লে ছাপ তিলক যায়…. আবার আমা হইতে জাতিকূল নাহি গেল রাখা… এও হয়। রাখবে না হারাবে? ভানুসিংহ হারাতে চেয়েছিলেন, তাই সর্বনাশের আশায় বসেছিলেন সকল নিয়ে। সর্বনাশ না হলে অভিসার সম্পূর্ণ হয় না। গরলামৃত পান না করলে জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ভোগের শেষ আছে। প্রেমের শেষ নেই। কৃষ্ণ সেই অনুভব। সেই প্রেম। কার কখন জাগে বলা যায় না। জেগে গেলে? ওই যে আছে না…. ছাই দিয়ে সংসারে…. সব শেষ দিয়ে সব শুরু হয় তখন…. তোমার এদিকের হিসাবের সূত্র ওদিকে বিফল… এদিকের সার্থকতা.. ওদিকের ব্যর্থতা.. আবার ওদিকের সফলতা এদিকের কাঙালপনা…. কে মেলাবে ভাই… কেউ পারেনি… পারবেও না কোনোদিন….