Skip to main content
 
 
সানগ্লাসটার দাম দেড়শো টাকা। সানগ্লাসটা চোখের উপর রেখেই নর্দমাটার দিকে তাকালো রাকেশ। তার নর্দমা ঠেলার ব্রাশটা লাঠির মাথায় বুক গুঁজে তার পাশে শুয়ে। নর্দমাটা তার দিকে তাকিয়ে স্নানের অপেক্ষা করছে। নর্দমাটার বুকের উপর সুপুরিগাছগুলোর ছায়া সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছে। এরকম একটা সুপুরিগাছের গায়েই ঠেস দিয়ে বসে রাকেশ। মাঘের হাওয়া তার গায়ে জড়ানো দুর্বল সোয়েটারের বারণ মানছে না। হাড়গুলো রাকেশের বারণ উপেক্ষা করেও কেঁপে কেঁপে উঠছে। রাকেশ ভালো চোখে দেখছে না শীতের হাওয়াকে, তবু প্রশ্রয় দিতে হচ্ছে, যেমন সে অনেক কিছুকেই দেয়।
       নর্দমার মধ্যে কত কি ভাসছে। পিজবোর্ড, ভাঙা কৌটো, কয়েকটা ব্যবহার করা কণ্ডোম, ছেঁড়া খাতা, প্লাস্টিকের হাতল - কোন কিছুর একটা, আরো কিছু কিছু পাঁকে ডুবে কালো হয়ে নিজেদের আকার আকৃতি হারিয়েছে।
       রাকেশ সানগ্লাসটা একবার খুলল। প্রচণ্ড চড়া রোদ, চোখটা টাটিয়ে উঠল। সাড়ে ন'টা বেজে গেছে, মোবাইলটায় টোকা মেরে সময়টা দেখে আবার মুখ ফেরালো সামনের সার দেওয়া বাড়িগুলোর দিকে। এতগুলো কণ্ডোম কারা ফেলে?
       মাথাটা ঝিমঝিম করেই যাচ্ছে। প্রকাশ বলেছিল, এত খেও না... শ্যালা... বমি বমি পাচ্ছে। আজকাল নোংরা নর্দমা দেখলে বমি পায় না, পরিষ্কার মানুষ দেখলে পায়, মাথার ভিতর ল্যাওড়া পোরা শালা...
       মালতী কথা বলত না শেষের দিকে আর। কথা বলতে গেলেই রেগে কাঁই হয়ে যেত। তার সাথে শুতো যখন, পুরো ঠাণ্ডা, যেন চৌকিটার সাথে মিশে নিষ্প্রাণ হয়ে গিয়েছে। রাগ লাগত রাকেশের। ক্ষোভ হত। চব্বিশ-পঁচিশেই কেউ ঝিমিয়ে যায় এমন? পরে জেনেছিল, অনেক পরে জেনেছিল সব রস তো আগেই নিয়ে নেয় বড়বাবু। রেলের আরপিএফ। ওর বাড়িতেই কাজ করত মালতী। অত্যাচার করত। কাজ ছেড়ে দিতে চাইলে ও আর ও'র বউ দু'জনেই ভয় দেখাতো। ওর বউয়ের কি অসুখ না ব্রত ছিল যে সে বরের সাথে শুতো না।
       তবু যায়নি রফা করতে রাকেশ। গতমাসে নার্সিংহোমে শুয়ে সব বলে দিল মালতী। ফিসফিস করে কানের কাছে। বালিশ, চাদর, লোহার খাট সব শুনল। মালতী হাঁপাচ্ছিল। ওর হিমোগ্লোবিন সাড়ে পাঁচ, ডাক্তার বলেছিল। মালতী ভেবেছিল ও আর বাঁচবে না। কিন্তু আরো এক মাস বেঁচেছিল, গলায় দড়ি দেওয়া অবধি গতকাল। পাখাটার গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে ঝুলে পড়েছিল, পাখাটা আটকালো না ওকে। নাকি আটকাতে গিয়েছিল? একটা ব্লেড বেঁকে গিয়েছিল, জটায়ুর মত।
       নার্সিংহোমে সব শোনার পর মাথাটায় আগুন ঝরছিল। সোজা রেলকলোনীর বড়বাবুর বাড়ি গিয়েছিল। বড়বাবুর জ্বর। টাকা ভালোই দিত মালতীকে, বড়বাবুর দিকে তাকাতে তাকাতে মনে পড়ে গেল আরো কত কি যেন। তার জন্য প্রতি দেওয়ালিতে জামাপ্যান্ট পাঠান, তার নেশার টাকাও মালতীই দিয়েছে অনেকবার, যা এই বড়বাবুর টাকা, ঝি-কে এত টাকা কেউ দেয়? সত্যিই কি কিছু বুঝত না সে? এক স্তনবৃন্তে বড়বাবুর জর্দার গন্ধ পেয়ে অন্য স্তনবৃন্তে মুখ গুঁজত না সে? কখনও কখনও সারা শরীরে জর্দার গন্ধে সে কুকুরের মত একটা গন্ধহীন ছাইগাদা খুঁজত না মালতীর শরীরে? একবার মারামারি করে লক-আপে ছিল দুই রাত, বড়বাবুই ছাড়িয়ে এনেছিল। রাকেশ বড়বাবুকে প্রণাম করে, এককাপ চা, লুচি-তরকারি খেয়ে, এক হাজার টাকা নিয়ে সোজা মদের দোকান চলে গিয়েছিল। দু'দিন নার্সিংহোম যায়নি। ভেবেছিল মরে গেলে এমনিই নার্সিংহোমের পিছনের রেললাইনে ফেলে দেবে মালতীকে। মরেনি মালতী। কাল মরল। এখন ভূত হয়ে ঘরের মধ্যে শুয়ে। সকালেই দেখে এসেছে রাকেশ। ছাদের গায়ে টানটান হয়ে শুয়ে, পাখাটা হাত দিয়ে ঘোরাচ্ছে, বিয়ের বেণারসীটা পরে আছে।
       বমি হয়ে গেল রাকেশের। বড়বাবু মারা গেছে দু'দিন আগে, এইডস্ হয়েছিল। মালতীরও তাই ছিল। তার নিজের রক্ত পরীক্ষা করালেও এইডস্ ধরা পড়বে। নইলে এত পায়খানা হয় কেন? মালতীর হত, আর জ্বর। নর্দমায় কণ্ডোমগুলোর দিকে তাকালো রাকেশ। বড়বাবু, মালতী, সে কণ্ডোম ব্যবহার করত না। তারা তিনজনেই নর্দমায় শুয়ে এখন। সুপুরিগাছে হাওয়া খেলছে। নর্দমার গা থেকে ছায়াটা সরে এখন রাস্তার উপর। নর্দমার জলের উপর সূর্যের তীব্র গোলাটা ছিটকে তার চোখে লাগছে। সানগ্লাসটার উপরে আলোর গোলা, সূর্য।
       রাকেশ উঠে দাঁড়ালো। মাথাটা চক্কর দিতেই আবার বসে পড়ল। ধীরে ধীরে আবার উঠে দাঁড়ালো। মালতীকে খাটে শুইয়ে দিয়ে বড়বাবুর শ্রাদ্ধ খেতে যাবে, আজ নেমন্তন্ন তো তার। বড়বাবুর বউ-এর সাথে একদিন রক্ত পরীক্ষা করতে যাবে দূরে কোথাও। তারপর মরে পড়ে থাকবে দু'জনে যে যার ঘরে। রাকেশ আরেকবার নর্দমায় ভাসা কণ্ডোমগুলোর দিকে তাকালো। সূর্যের আলোয় ভাসা কণ্ডোমের মুখ। রাকেশের কান্না পেল। সুপুরিগাছটা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে সব অন্ধকার হয়ে যেতে লাগল। শরীরটা ছেড়ে দিচ্ছে। রাকেশ মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ল। নর্দমায় ডুবে মুখটা। জোরে শ্বাস টানতে গিয়ে একটা কণ্ডোম গলায় আটকে গেল। রাকেশের শরীরটা দু'বার কেঁপে স্থির। তার পিঠের উপর সুপুরি গাছের ছায়া, দুলে দুলে যেন আদর করে দিচ্ছে, হাত বুলিয়ে, ভালোবাসায়। ছায়া নয়, ও মালতী।