- আলুভাজা কি অতিরিক্ত ছিল?
- জানি না।
- তবে আমার পাতে এল কেন?
- মনে হল তাই দিলাম।
- এ আলু কি তুমি ভেজেছ?
- না।
- এ আলু কি আমার জন্য ভাজা হয়েছিল?
- না।
- তবে?
কিন্তু ততক্ষণে তার আলুভাজা মাখা মুড়ি খাওয়া হয়ে গিয়েছে। স্বাদ কেমন ছিল বুঝতে পারেনি। মনের মধ্যে সংশয় ছিল। সংশয়ে সব স্বাদ নাগালের বাইরে চলে যায়। এ আলুভাজাটা তো তার জন্যে নয়, তবে, একি চুরি না?
কেউ টের পেল না, আলুভাজার পরিমাণ কিছুটা কম। সে তো জানল। চুরির দাগাটা বুকে গিঁথে গেল। খাবার টেবিলে ঢাকা আলুভাজার থালা। যে তার পাতে তুলে দিয়েছে সে বাড়ির কেউ নয়। বাড়ির কেউ না হলে বাড়ির কোথায় পচা গন্ধ টের পাওয়া যায় না। মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধির বাইরে আরেক বুদ্ধি আছে - সঙ্কীর্ণ বুদ্ধি, সংসারে তার কদর বড় কম নয়!
মানুষ কতভাবে অপরাধী হয়। আগে বাড়ির হিসাব ছিল অন্য। এখন অন্য। এখন আগে বুঝে নিতে হয় তার জন্য বরাদ্দ কতটুকু? ভালোবাসা যখন ছিল, তখন নিজের বাড়িতে 'চুরি' শব্দটা জন্মায়নি। তখন 'আপন' শব্দটা আদুরে বেড়ালের মত রোদ পোহাতো যেখানে সেখানে। সে চেনা শব্দ ছিল। বকাঝকা ছিল। নিন্দা তিরস্কার ছিল না। ভালোবাসা না থাকলে টেবিলে ঢাকা আলুভাজার হিসাবও মানুষকে চোর বানায়। লোভ না স্বভাব? নাকি নির্বুদ্ধিতা?
মানুষটা একা একা বসে ছাদের এক কোণায়। নিজের কাছে নিজে ছোটো হয়ে গেছে। কারণ আলুভাজাটা খাওয়ার সময় তার মনে হয়েছিল এ তার জন্য না। সে বুঝেছিল। তবু খাওয়া থামায়নি। লোভ। সে জানত যে এনেছে সে নিজেও আনেনি সঙ্গে করে। যে দিয়েছে সে তো বাইরের লোক। বাইরের লোক ঘরের মধ্যে কেন? একি তার অপরাধ না?
ভালোবাসা ফুরিয়ে গেলে মানুষকে কর্তব্যের বাঁধন বেঁধে রাখে। কর্তব্য ফুরিয়ে গেলে একা থাকতে হয়।
বাইরের মানুষ বাইরে চলে গেছে। ঘরের মধ্যে কয়েকটা চামচিকে ঘোরাফেরা করছে। ভাড়াটিয়ারা ঘুমিয়ে পড়েছে। একজন ভাড়াটিয়ার ঘরে মানুষটা খায়। টাকা দিয়েই খায়। এখন সবাই ঘুমাচ্ছে। লোকটার ঝিমুনি আসছে। ঘুমাতে পারছে না। বাড়ি ভর্তি ভাড়াটিয়া। তার ভালোবাসার বাড়িটা আর নেই। ভালোবাসা আর ভাড়ার মধ্যে পার্থক্য অনেক। ভাড়াটিয়াদের ভালোবাসার শর্তাবলী থাকে। লালদাগ থাকে, আর অনেক অভিযোগের ফাইল।
অন্ধকারে নিজের ঘরে বসে বসে লোকটা দাবার ছক সাজায়। সংসারে সম্পূর্ণ একা সে। তার প্রতিপক্ষও কেউ নেই। কিছু শকুন আছে। কিছু জীবাণু। আর ভাড়াটিয়ারা।
গভীর রাত। ভালোবাসার ভূত এসে বসে লোকটার সাথে এই সময়, একটা কালো চাদর গায়ে জড়িয়ে। দাবা খেলে। প্রতিদিন সে কালো ঘুটিগুলো নেয়। লোকটা সাদা। যতবার চেকমেট হয়, ভূতটা পালিয়ে যায়।
আজ কিন্তু পালাতে দেবে না। আজ অন্যমনস্কের মত খেলছে।
ভূতটা বলল, আমায় চেকমেট দাও। আমায় তাড়াও। সকাল হয়ে যাবে। আমি ফিরতে পারব না।
মানুষটা হাসল। বলল, কেন ফিরবে?
ভূতটা কথা বলল না। সমস্ত কালো ঘুটিগুলো দিয়ে নিয়ে মিলিয়ে গেল। লোকটার ঘুম ভাঙল যখন সকাল। সব ভাড়াটিয়ারা উঠে পড়েছে। তার পায়খানা পেয়েছে। একে একে ভাড়াটিয়ারা যাচ্ছে। মানুষটা পারছে না চেপে রাখতে আর। সব ভাড়াটিয়াদের হয়ে গেলে সে যাবে। অথবা কেউ যদি ছেড়ে দেয়।
এক একবার ভাবে সবাইকে তাড়িয়ে দেবে। দেয় না। ভাগ্যকে সম্পূর্ণ দেখতে চায়, এ মাথা, ও মাথা। ভাগ্যকে সম্পূর্ণ না মারলে আবার কোন ঝোপে ওত পেতে বসে থাকবে সে আর কে বলতে পারে? আধমরা ভাগ্য বড্ড জেদি। বড্ড ভয়ানক। ওদিকে ঈশ্বর মন খারাপ করে বসে থাকে তার মনের মধ্যে। বলে, ভালোবাসার মত সব ভাড়াটিয়ারা একদিন চলে যাবে। তুমি গভীর শূন্যতায় একা হবে।
মানুষটা আনন্দ পায় শুনে। শূন্যতাকে ভালোবাসতে গিয়েই বুঝেছে তার বুকের মধ্যে একজন শূন্যের জন্য সোয়েটার বোনে, নিভৃতে নিরালায়। একদিন গভীর শীতে কুয়াশার মধ্যে শূন্য এসে দাঁড়াবে তাকে নিতে। সে সোয়েটারটা তার হাতে দিয়ে বলবে, পরো।
শূন্য বলবে, আমার মাপ এত নির্ভুল জানলে কি করে?
লোকটা কিছু না বলে, হাসবে। তাকে বলবে, চলো।