Skip to main content

 

মাস্ক ঢাকা। তাই চোখজোড়া স্পষ্ট এখন। কত রকম চোখ। কত রকম চাহনি। নিরুত্তাপ, উদ্বিগ্ন, হাসিহাসি, কান্নাকান্না, রাগী রাগী।
       সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা হবে। টিভিতে একটা চটুল হিন্দী গান চলছে। ডিস্পেনশারিতে লোক নেই। রাস্তায় লোক কম। ডাক্তারবাবু চেম্বারে এসে গেছেন আধঘন্টা হল। চোখের ডাক্তার। সামনে সার দেওয়া চশমা রাখা। সামনের দিকটা দোকান। ভিতরে চেম্বার। আঁখি - দোকানের নাম।
       চশমার কাঁচের উপর রাস্তার লোকেদের ছবি। চলচ্ছবি। পাপিয়া সামনে রাখা আয়নায় নিজের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে। কাস্টমার না থাকলে এটা একটা খেলা। সানগ্লাসগুলো পরে পরে দেখে। অনেক সানগ্লাসে ভালো মানায় নিজেকে। নিজের রূপের নিজেই তারিফ করে। সাড়ে তিন হাজার টাকা মাইনে পায়। বাড়িতে মা আছে, আর দুই ভাই। দুজনেই স্কুলে পড়ে। মা রাণাঘাটে একটা নার্সিংহোমে কাজ করে। তাদের বাড়ি শিমুরালি, এই দোকান থেকে যেতে আধঘন্টা। সাইকেলে যায়। এই ডাক্তারবাবুই কিনে দিয়েছেন সাইকেল।
       বৃষ্টি শুরু হল। পাপিয়া হিটারটা অন করে চায়ের জল চাপালো। দুই কাপ। একটা চিনি দিয়ে। একটা চিনি ছাড়া। স্যারের সুগার। আটান্ন বছর বয়েস হল। বেশ শক্তপোক্ত চেহারা। পাপিয়ার বয়েস ছাব্বিশ।
       দোকানের ঝাঁপটা অল্প নামিয়ে দিল। প্রচণ্ড ছাঁট আসছে। স্যার ফোনে কথা বলছেন। নাতির সাথে। ব্যাঙ্গালোরে থাকে স্যারের মেয়ে, তার ছেলে। স্যারের মোবাইলে ছবি দেখেছে। ভীষণ কিউট!
       এক কাপ চা, দুটো ক্রিম ক্র‍্যাকার বিস্কুট ক্যাশবাক্সের পাশে রাখা কৌটো থেকে বার করে ডিশে রাখল। ডিশটা হলুদ হয়ে গেছে। পাল্টাতে হবে। স্যারের চেম্বারে গিয়ে টেবিলের উপর রাখল। ডাক্তার মাইতি একটু হেসে মাথা নাড়লেন। নাতি রাইম শোনাচ্ছে মনে হল। পাপিয়াও জানে, জনি জনি ইয়েস পাপ্পা... ইটিং সুগার?... নো পাপ্পা... ওপেন ইয়োর মাউথ... হা হা হা.... ডুবে ডুবে জল খাওয়া বাচ্চা। বড়দের যদি জিজ্ঞাসা করো, ইটিং মেয়েমানুষ? হা হা হা...
       পাপিয়া চা নিয়ে বসল। টিভিটায় গান পাল্টালো। কম প্রেমিক ছিল তার এককালে? এখন আর ভালো লাগে না। রজত আত্মহত্যা করার পর সব বদলে গেল। এত ভালোবাসত কোনোদিন বুঝলই না পাপিয়া, নিজেকে ছোটো লাগত আগে। এখন আর লাগে না। আগে মনে হত রজত হয় তো অন্যদের মত শুধু শরীরটুকুই ভালোবাসে তার, ওই জন্যেই হয় তো ছুঁকছুঁক করে। কিন্তু সেদিন যখন ঘটল ঘটনাটা....
       বছর চারেক আগের কথা। পাপিয়া ভোরবেলা দাঁত মাজছে পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে, হঠাৎ চুমকি সাইকেল নিয়ে হুড়মুড়িয়ে এসেই বলল, শুনেছিস? রজতদা আজ ভোরের লালগোলায় লাইনে গলা দিয়েছে... কোনো সুইসাইড নোট লিখেও যায়নি... কি হল বল তো... তুই কিছু জানিস? তোর সাথে ঝগড়া হয়েছিল?
       পাপিয়ার মুখ থেকে ব্রাশটা মাটিতে পড়ে গেল। তার নিজের মোবাইলের স্ক্রিণটা মনে পড়ছে। গতকাল রাতে।

       তুই সত্যিই আমায় ভালোবাসিস না?
       না
       আমি চলে গেলেও তোর কিচ্ছু আসে যায় না?
       না...
       ব্যস। মোবাইল অফ করে দিয়েছিল রজত। সাইকেলের দোকান ছিল। দেখতে ভালো ছিল না। পাপিয়ার মনে হত তার জন্য অনেক ভালো ছেলে অপেক্ষা করে আছে। একজন অপ্টোমেট্রিস্টকে ভালো লাগত। বিশ্বনাথ বোস। কি দারুণ দেখতে। পাপিয়ার দিকে যেরকম তাকাত মনে হত ওর কিছু একটা আছে পাপিয়ার উপর। কিন্তু হঠাৎ কাজ ছেড়ে দিল। আসলে হঠাৎ না।
       পাপিয়া ক্যাশবাক্স খুলে একটা সানগ্লাস বার করল। আয়নাটা সরিয়ে সানগ্লাসটা রেখে একটা টিস্যু দিয়ে মুছল ভালো করে। চায়ে একটা চুমুক দিয়ে সানগ্লাসটা পরল। এইবার ডান দিকে তাকালো। ওই তো, রজত বসে আছে। তার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে। রোজ আসে, এই সময়ে। অনেক কাস্টমার থাকলে পাপিয়া সানগ্লাসটা পরার সময় পায় না, পরে রাতে বাড়ি ফেরার সময় সাইকেল চালায় সানগ্লাসটা পরে। সামনে সামনে রজত যায়। যেন ভেসে ভেসে।
       বিশ্বনাথের সানগ্লাস এটা। বিশ্বনাথ একদিন চেম্বার থেকে চীৎকার করে ওঠে। সবাই ছুটে ভিতরে গিয়ে দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে বিশ্বনাথ। সানগ্লাসটা পাশেই পড়ে। পাপিয়া কুড়িয়ে রেখেছিল, দামী ব্র‍্যাণ্ডের। একদিন এমনি খেয়ালের বশে চোখে দিতেই দেখে, রজত সামনে দাঁড়িয়ে। তার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে।