সুখ কাকে বলে? দার্শনিক মত নানান হতে পারে, আমি একদম এলেবেলে মত নিয়ে বলি।
ধরুন আমার দাঁতে ব্যথা হয়েছে। ডাক্তার বলেছে, নিচের পাটির প্রিমোলারে ভাঙ্গন ধরেছে, জানান দিচ্ছে। দাঁতের ভাষায় দাঁত জানান দেবে -- কনকন, টনটন, ঝনঝন, মাথার মধ্যে চড়াং ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রকারের। ধরুন তখন আমি কারোর বাইকের পিছনে বসে বাজারে যাচ্ছি। তখন আমার মনে হবে যাদেরই দাঁতে ব্যাথা নেই তারাই সুখী। যেমন, সামনে যে লোকটা টোটো চালাচ্ছে বিড়ি খেতে খেতে, যে ছেলেমেয়ে দুটো শ্রীনিকেতনের বাইরে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে গল্প করছে, যে তিনজন বয়স্কা মহিলা মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে প্রবল হাসাহাসি করছে --- আমার সবাইকে দেখে গা-পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, দাঁতে ব্যাথা হয় নি তো, তাই এত সুখ।
এইবার আপনি দাঁতে ব্যথার সঙ্গে অর্শ্বের ব্যথা, বগলে ফোঁড়ার ব্যথা, গ্যাস-অম্বলের ব্যথা ইত্যাদি থেকে করোনা, ডেঙ্গু ইত্যাদির মতন হাই প্রোফাইল রোগ অবধি ভেবে নিতে পারেন।
এবার ধরুন যখন আমার কোন অসুবিধা নেই, ব্যথা নেই। অর্থাৎ আভিধানিক মতে এবং আইনসঙ্গতভাবে আমি সুখী। কিন্তু আমি নিজেকে সুখে থাকতে দেব না। কেমন?
যেমন ধরুন আমি আবার কারোর বাইকে চড়ে যাচ্ছি। তখন আমি আর টোটোওয়ালার দিকে তাকাব না। আমি চারিদিকে খুঁজব আমার থেকে বেশি কে সুখী। সামনে যে লোকটা চার চাকা গাড়ী চালিয়ে আমাকে ওভারটেক করে গেল, কিম্বা যে রোগা প্যাঙলা ছেলেটার পিছনে একজন অপূর্ব সুন্দরী তার কোমর জড়িয়ে চলে গেল, কিম্বা যে মানুষটা সপরিবারে একটা রেস্টুরেন্টে বসে খাবারের অর্ডার দিল --- সবার উপর আমার বিষাক্ত নজর।
একবার প্লেনে চড়ে গুয়াহাটি থেকে কলকাতা আসছিলাম। প্লেনে আমার ভারি ভয়। প্লেনটা আকাশ ছোঁয়ার আগে অবধি হাড়েমজ্জায় টের পাচ্ছিলাম ভয় কাকে বলে। জগৎ চরাচরে দেহ ও প্রাণের যুক্তাবস্থা টিকিয়ে রাখার চেয়ে দামী আর যেন কিছু নেই। কিন্তু যেই সেসব ল্যাঠা চুকে গিয়ে প্লেনটা মাঝ আকাশে তার কাঙ্ক্ষিত উচ্চতায় যেতে শুরু করল, তখন আমি ভুলে গেলাম আমি একটা উড়ন্ত যানে বসে আছি। কারণ কোথাও কোনও পরিবর্তন নেই, শুধু একটা যান্ত্রিক আওয়াজ। আমার চোখ গেল আশেপাশের সীটে। কে যেন ভাল জানলা পেয়েছে, কার সামাজিক অবস্থান যেন সত্যিই ঈর্ষনীয়, কার আত্মবিশ্বাস যেন ঈশ্বরকেও লজ্জা দিয়ে তাকে নাস্তিক হওয়ার সম্ভ্রম এনে দেয়। আমি আবার দুঃখী হলাম।
দস্তয়েভস্কি Notes From The Underground-এ বলেছিলেন, মানুষের অপরিসীম ক্ষমতা আছে নিজেকে অসুখী রাখার। মানুষ তাই সত্যিকারের আন্তরিক - দুঃখে বিপদে। কোথাও যেন নিজেকে নিয়ে সুখীও। আন্তরিকতার সুখ। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে অন্যমনস্ক হওয়া যায় না --- একাগ্রতার সুখ। সে অবস্থা কাটতেই একটা জায়মান সুখের ধাক্কা এসেই মিলিয়ে যায়। মানুষ নিজেকে নিয়ে আবার দুঃখ দুঃখ খেলে। যতক্ষণ না রিং-র ভিতর ডাক পড়ে।