সভা হচ্ছে। ধর্মসভা। গরমে ঘেমেনেয়ে একশা সব। বক্তা বলছেন --- বুদ্ধের উপাখ্যান। কিন্তু বলতে দিলে তো? আশপাশে গুচ্ছের ছোটো ছোটো পোকা নাকের সামনে দিয়ে, চোখের সামনে দিয়ে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে।
ঘরোয়া ধর্মসভা। তবে বেশ বড় হলঘর। জনা পঞ্চাশেক লোক হবে। সামনের সারিতে বেশ কয়েকজন চোখ বন্ধ করে ধর্মকথা শুনছেন। বুদ্ধ সবে সাধনা শুরু করেছেন। গাছের তলায় বসে। কিরকম গরম লাগতে থাকবে সচ্চিদানন্দ মুখুজ্যে মনে মনে ঠাহর করতে পারছেন না। ঘরে চার-চারটে পাখা চলছে, দুটো ছাদ থেকে ঝুলছে, দুটো মেঝেতে দাঁড়িয়ে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরছে। তাতেই এই গরম! তিনি ওই গাছের তলায়, পেরেছিলেন কি করে? মহাপুরুষ বলে কথা। যা হোক। সচ্চিদানন্দবাবু'র কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে ঘাড় হয়ে সিল্কের পাঞ্জাবী'র মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। সহ্য হয়ে গেছে। সচ্চিদানন্দবাবু'র বিরাট ব্যবসা। এই বাগনানে কত বাড়ি যে ওনার বানানো উনি নিজেই এখন মনে রাখতে পারেন না। সেই ষোলো বছর থেকে ব্যবসায় নেমেছেন। ধর্ম, অর্থ, কাম কি নেই জীবনে? শুধু মোক্ষটাতেই যা আটকে। তবে হয়ে যাবে। এমনিতেই এই ছাপান্নতে এসে ভোগে বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে। তায় প্রেসার, সুগার, থাইরয়েড, একটা প্রায় শাটডাউন কিডনি, আধখানা পাল্লা খোলা হৃদযন্ত্র... এই সব নিয়ে আর কদ্দিন?
বুদ্ধের শক্তি কমে আসছে সাধনার। প্রায় দাঁড়াতে পারে না। ভাবতে পারেন না। কিন্তু পরিতোষ সামন্ত, মানে বক্তাও আর দাঁড়াতে পারছেন না, বলতে পারছেন না। গলায়, ঘাড়ে কুটকুট করে ইতিমধ্যে কামড়িয়েছে দুটো। কি জ্বালা রে মাইরি! পরিতোষ সামন্ত, বয়সে প্রায় সচ্চিদানন্দের কাছাকাছি। প্রধান শিক্ষক ছিলেন কোনো এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। জীবনে ধর্ম, অর্থ, কাম কোনোটাই পূর্ণতা পায়নি। মোক্ষটাও আধাখ্যাঁচড়া। মাঝে মাঝে মনে হয় বৈরাগ্য চূড়ান্ত। সব ছেড়ে চলে গেলেই হয়। যাওয়াও যায়, হৃদয়ে মশালের মত জ্বলতে থাকা বৈরাগ্যের উপর ভরসা নেই তা নয়, কিন্তু পেট? আজন্ম আমাশার ধাত। যখন তখন যেখানে সেখানে পেট মোচড় দেবে, যেতেই হবে তখন। যেতেই হবে মানে যেতেই হবে। নইলে? থাক সে কথা। শাস্ত্রে উপস্থ-জিহ্বা নিয়ে যত বাণী আছে, তত ক্রনিক আমাশায় সংযত চিত্ত থাকার উপায় নিয়ে আলোচনা হয়নি কেন কে জানে! উপস্থ-জিহ্বা তবু সংযত রাখা যায়, ভয়ে বা লজ্জায় যা হোক, ভদ্রতা রক্ষা করা কঠিন না, কিন্তু এতো না ভয় মানে, না লজ্জা!
ভাবতে ভাবতেই মোচড় দিল। এতক্ষণ গরমের জন্য ঘামছিলেন পরিতোষবাবু, এবার আশঙ্কার পীড়নে ঘামছেন। সবে তো বুদ্ধ আসনে বসে আছেন। এখনই মোচড়! মাগো! কানের ঠিক পিছনে কামড়ালো আবার!
পরিতোষবাবুর কথা জড়াচ্ছে। জড়াচ্ছে ঠিক না, হারাচ্ছে। বলছেন, “বুদ্ধ এত দুর্বল হলেন যে মলমূত্র ত্যাগ করতে গিয়েও জ্ঞান হারাচ্ছেন। উনি ভাবলেন, এভাবে তো চলে না...”
তলপেট হয়ে মোচড়টা কোমরটাকে পেঁচিয়ে এমন একটা হল্কা দিল অজান্তেই পরিতোষবাবু একবার নিজের পরিধানের সাদা ধুতির শুষ্কতা পরিমাপ করে নিলেন। আপাতত... কিন্তু এরপর...
“তখন বুদ্ধ দেখেন সামনে থেকে একজন আসছেন...”
পরিতোষবাবুর কথা বন্ধ। একটা পোকা, এবারেরটা সাইজে বড়, কানের লতি কামড়ে ঝুলে পড়েছে...
“সামনে যিনি আসছেন পায়েসের বাটি নিয়ে...”
বাক্য আর সরছে না... ওদিকে সচ্চিদানন্দবাবু পরিতোষবাবুর একেবারে সামনেই বসে থাকলে কি হবে, চোখ তো বন্ধ! তিনি বারবার ভাবের চোখে দেখছেন বুদ্ধ ধ্যানে বসে। কুলকুল করে ঘামছেন। একটা হাইপোগ্লাইসেমিয়া অ্যাটাক হব হব করছে। এমন সময় এক রমণী বাটি হাতে গজেন্দ্রগমনে এগিয়ে আসছেন। কিন্তু তারপর? বারবার এই সিনটা রি-ওয়াইন্ড হয়ে যাচ্ছে কেন? উনি আর ধৈর্য না রাখতে পেরেই বললেন, “আরে মশায় সুজাতা... সুজাতা...”
পরিতোষবাবু এতক্ষণ একাই বলে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ সচ্চিদানন্দবাবুর গলায় উনিও যেন কেমন চমকে উঠে বলে ফেললেন, “আরে মশায় সুজাতা নয়, পোকা পোকা... এই দেখুন আমার কানের লতি ধরে ঝুলছে...!!!”
সচ্চিদানন্দবাবু চোখ খুলে, চশমাটা কোল থেকে তুলে ভুরু কুঁচকে মনকে বুদ্ধ থেকে পরিতোষবাবুর কানের লতিতে আবদ্ধ করে বললেন, "তাই তো...! ও কি পোকা? বিষাক্ত?"
পরিতোষবাবুর কথায় এতক্ষণে গৃহকর্তা বলাই মণ্ডল এগিয়ে এলেন। তিনি লতি থেকে পোকাটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, "না না বিষাক্ত হবে কেন? তবে জ্বলুনী আছে। আমার বড় ছেলের নুনুতে একবার এমন কামড়েছিল..."
শ্রোতাদের মধ্যে থেকে একটা নারীকণ্ঠ ভেসে এল, আঃ...
কণ্ঠস্বরটি বলাইবাবুর বড় ছেলের স্ত্রী। আসলে বলাইবাবু জ্ঞান হওয়া ইস্তক ইটের গোলা, ইটভাটা নিয়ে আছেন। এক-এক সময় ওনার মনে হয় ওনাকে ওনার বাবা হয়তো এই ইটভাটার চুল্লীর ভিতর থেকেই পেয়েছিল। ভাষাজ্ঞান নিয়ে একটু সমস্যা ওনার সেই থেকেই। যদিও ধর্ম, অর্থ, কামের সমস্যা নেই। তবে মোক্ষ নিয়ে ওনার ভয়। এতবড় ব্যবসা, সব ব্রহ্মে মিশলে তো গেছেন। সেখানে তো শুনেছেন লাভ আর লোকসানের মধ্যে নাকি ফারাক বেশি নেই।
যা হোক বলাইবাবু নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, "সে অবশ্য অনেক ছোটোবেলার কথা... পুকুরধারে স্নানে যেত তো... এই পোকা ওই কাঁঠালগাছে হয়..."
এদিকে পরিতোষবাবুর কানের লতি ফুলে একটা ফুলুরির সাইজ হয়েছে। সচ্চিদানন্দবাবু বললেন, "আপনি শেষ করে নেন দাদা, সুজাতা পায়েস দিল... তারপর?"
এদিকে যারা পিছন দিকে বসেছিল, বিশেষ করে যাদের সামনের দিকের কথা ভালো করে কানে আসছিল না, তারা এতক্ষণ ভাষণের বিরাম শুনে ভেবেছে বুঝি হয়ে গেছে, তারা সমস্বরে 'হরিবোল, হরিবোল' বলে চীৎকার করতে শুরু করে দিল। সাথে সাথেই খোল-করতাল বেজে উঠল। কেউ বুঝে, কেউ না বুঝে একসাথে সবাই উলুধ্বনি শুরু করে দিল। শাঁখ, কাঁসর বেজে উঠল।
পরিতোষবাবু এত গোলোযোগ দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ভিড় ঠেলে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে রওনা দিলেন। মোক্ষ হোক না হোক, মুক্তিবেগ অত্যন্ত প্রবল তলপেটে। সচ্চিদানন্দবাবু ভাবের খাতায় কলম ঢুকিয়ে চোখ বন্ধ করে পরের অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। সুজাতার আর আসা হল না। মুখটা চেনা চেনা লাগছিল। ভাবে এত কাছে আসে মানুষ, ঈশ্বর! কাকে ছেড়ে কাকে নেবেন?
[ছবি: Suman]