Skip to main content

গোঁসাই বলল, দরদীকে খোঁজো, নইলে সব ফাঁকি। ফাঁকিতে কি জীবন চলে?

একজন বলল, দরদী পাই কই?

গোঁসাই বলল, দরদ দিয়ে তাকা, দরদ দিয়ে শোন, দরদ দিয়ে ছোঁ। দেখ দরদের ঝুনঝুনি বাজছে জগতে।

সে বলল, পেলাম তো শুধু আঘাত গোঁসাই…. দরদ কই?

গোঁসাই বলল, পাবি রে পাবি... হাল ছাড়বি কেন?

দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো একজন। বলল, গোঁসাই, হরেনের মা এসেছে।

গোঁসাই বলল, গোবিন্দের ওখানে নিয়ে যা। চন্দন বাটতে বল।

সে চলে গেল। একজন জিজ্ঞাসা করল, এই সেই হরেন? যে সেই চুরি করে পালাতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মরল…

গোঁসাই উত্তর করল না। জানলার বাইরে তাকিয়ে রইল। বলল, গোবিন্দ জানে, শুধু নিয়মে জগত চলে, কিন্তু প্রাণ চলে না। গোবিন্দ তাই শাস্ত্রে নিজেকে বলেছে "সুহৃদ", সর্বজনের সুহৃদ। সেকি শূন্য কথা গা!

গোঁসাই উঠল। গোবিন্দের ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। হরেনের মা চন্দন বাটছে। চোখ মুছছে আঁচল দিয়ে মাঝে মাঝে। গোঁসাই মন্দিরে ঢুকল না। কাঁদুক। মানুষ যতক্ষণ না অন্তর্যামীর কাছে কাঁদে ততক্ষণ তার মুক্তি নেই। কাঁদুক সে, অন্তর্যামীর কাছে কাঁদুক। বাইরে তো এ উপলক্ষ মাত্র।

গোঁসাই স্নানে যাবে। একজনকে বলল, হরেনের মাকে বলিস যেন দুপুরে প্রসাদ পেয়ে যায় এখানে।

গোঁসাই স্নানে নেমেছে গঙ্গায়। তিন চারটে ডুবের পর পাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখে কে যেন দাঁড়িয়ে। কে? চোখ স্নানের জলে ঝাপসা। ভালো করে খেয়াল করে দেখল। সে পাড় থেকে বলল, আমি হরেন গো গোঁসাই। মায়ের সঙ্গে কিছু কথা আছে। কিন্তু মন্দিরে ঢুকতে পারছি না।

গোঁসাই পাড়ে উঠে এলো।

হরেন বলল, মাকে বলে দেবেন যে আমার অনুশোচনার অন্ত ছিল না জীবনে, কিন্তু ফেরার সাহস ছিল না। আমি খুব ভালোবাসি মাকে, কিন্তু বলতে পারিনি কোনোদিন।

গোঁসাই মন্দিরে ঢুকল, সঙ্গে একটা জবা আর ধুতুরা ফল নিয়ে সাজিতে।

পূজারী হেসে বলল, তোমার কি মাথা খারাপ হল ঠাকুর, এ যে গোবিন্দ বিগ্রহ। তুমি কি কালীপুজোর ভাবে আছো নাকি আজ?

গোঁসাই বলল, ওরে এ ধুতুরাফলে বিষ আছে। সে বিষ গোবিন্দ ছাড়া কে নেবে? কালিয়া যখন হার স্বীকার করে বিষ ঢেলে দিচ্ছিল গোবিন্দের পায়ে, তখন গোবিন্দ আমার ফাজলামি করে বলেছিল, ওরে কত মানুষ আমায় কত মাখন-চিনি খাওয়ায়, আর তুই কিনা আমায় বিষ দিচ্ছিস?

তখন কালিয়া বলেছিল, তা তুমি নিজে যা আমায় দিয়েছ, আমি তাই তো দিতে পারি প্রভু, তুমি যদি মাখন চিনি দিতে তবে তাই দিতাম।

এ বিষফলও গোবিন্দের ভোগ তাই। দেওয়ার ইচ্ছাটা আন্তরিক হওয়া চাই বুঝলি, দেওয়ার সামগ্রী যা হয় হোক!

হরেনের মা মন্দিরে এক কোণায় বসে। গোঁসাই তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, মা, এই ফল আর ফুল মাকে দে দেখি।

হরেনের মা চারদিকে তাকিয়ে বলল, মা কোথায় গোঁসাই? এ তো গোবিন্দ!

গোঁসাই বলল, ওই মা। তোর ছেলে কি ফিরতে চাইনি রে, ফিরতে চেয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজ যাওয়ার পথ যতটা প্রশস্ত করে দেয়, ফেরার পথ কি আর ততটা চওড়া করে বল! সবই তো জানিস। তোর মায়ের মন। তুই তো সবটাই জানিস। গোবিন্দকে মা বলে জান। তবে তোর শোকের মধ্যে জাগবে বিশ্বমায়ের করুণা। সেই পথে সে ফেরার রাস্তা পাবে তোর কাছে।

গোঁসাইয়ের হাত থেকে ফল আর ফুল নিয়ে হরেনের মা দিল ফুল গোবিন্দের পায়ে। ফুল দিতে দিতে হঠাৎ মনে হল তার পিছনে দাঁড়িয়ে হরেন। তাকে ডাকছে, মা! আমি এসেছি গো... আমায় নেবে না তুমি!

হরেনের মা, হাউহাউ করে কেঁদে পড়ল গোবিন্দের পায়ে। গোঁসাই পূজারীকে ইশারা করল বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে। গোঁসাই হরেনের মায়ের পাশে বসে বলল, যা শুনেছিস সত্যি রে মা! সে এসেছে। তুই কাঁদ, প্রাণ খুলে কাঁদ। সে আর তুই দু'জনেই হালকা হ মা। গোবিন্দকে আমার শুধু সুহৃদ বলে জানিস। আর কোনো নাম, কোনো পরিচয় জানার দরকার নেই রে! কাঁদ, প্রাণ খুলে কাঁদ। অন্তর্যামীর কাছে না কেঁদে কেউ কোনো উপায় পাইনি কোনোদিন মা! কাঁদ, কাঁদ।